সোশ্যাল মিডিয়া

এমন কী ঘটেছে, যার জন্য পুরস্কার পেতে হবে!

মজিদ মাহমুদ

Advertisement

এ দেশের অনেক কবি-সাহিত্যিক মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের পরেও বাংলা-সাহিত্যে অন্তত একশজন লেখক জন্মেছেন, যারা নোবেল পেতে পারতেন; নোবেল সাম্রাজ্যবাদীদের পুরস্কার, রবীন্দ্রনাথকেও ওই একই কারণে পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছিল; এ বছরের নোবেল পুরস্কার সেই ধারণা আরও সত্যে পরিণত করেছে। যদিও এসব পুরোনো কথা, তবু তার সারবত্তা নিয়ে দ্বিমত নেই; তবু ভেবেছি, সত্যিই কি বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পরে এত অধিক সংখ্যক বিশ্বমানের লেখকের জন্ম হয়েছে!

পুরস্কার কোনো লেখকের মাপকাঠি নয় ধরে নিয়েও বলা যায়, নোবেল ইউরোপীয় পুরস্কার হিসাবে বিবেচিত; বলা হয়ে থাকে, ইউরোপ-আমেরিকায় ৯টি যাওয়ার পরে দশম পুরস্কারটি অন্য মহাদেশে ভাগ হয়ে যায়; যদিও সম্প্রতি এর চিত্র কিছুটা পাল্টেছে। কিন্তু আমার ভাবনা, বাঙালি গুণগত মানবিচারে প্রায় সকল ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার পরে কিভাবে সাহিত্যে এত উর্বরতার পরিচয় দেয়।

যে জাতি খেলাধুলার ক্ষেত্রে প্রায় সকল জাতির নিম্নে, ফুটবল কিংবা অলিম্পিকে প্রাথমিক অনুশীলনে যারা বাদ পড়ে যান; ক্রিকেটে কিছুটা এগোলেও এখনো এটি ব্রিটিশ প্রভু ও তার সাবেক অনুগতদের খেলা হিসাবেই বিবেচিত; শিক্ষা ও বিজ্ঞানে তার তো কোনো অবস্থানই নেই। প্রতি বছর ৫টি বিষয়ে কমবেশি ১০ জন এই পুরস্কারে ভূষিত হলেও, তার কোনো একটি পাওয়ার যোগ্য বলে বাঙালি ভাবিত নয়; তবে সাহিত্যে এমন কী ঘটেছে, যার জন্য তার এই পুরস্কার পেতে হবে!

Advertisement

সাধারণ আলোচনায় যদিও ধরে নেওয়া যায়, নোবেল পেয়েছেন এমন অনেকের মান হয়তো বাংলা সাহিত্য নির্মাতাদের অনেকের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নন; বিশেষ করে উপন্যাসে তিন বন্দ্যোপাধ্যায় ও কবিতায় নজরুল ও জীবনানন্দ দাশসহ কয়েক জন। তাদের মান নিয়ে প্রশ্ন না তুলেও আমরা বিচার করতে পারি, সত্যিই কি এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের উপন্যাসে জীবন-বোধের এমন কোনো চূড়া নির্মাণ করতে পেরেছিলেন- যা মানব চেতনাকে কিছুটা অগ্রবর্তী করেছে! এদের কি কেউ একজন আলবেয়ার কামু, জাঁপল সার্ত্রে, বরিস পাস্তারনাক, এমরে কার্তেজ, গুন্টারগ্রাস কিংবা হোসে সারামাগো।

আরও পড়ুন আল মাহমুদ এক জাজ্বল্যমান ইতিহাস  শিল্পাচার্যের আঁকা একটি ছবি নিয়ে প্রশ্ন এবং জবাব 

হ্যাঁ, অবশ্যই আমি মনে করি, তাদের মধ্যে জীবনবোধের একটি ইঙ্গিত দেখা দিয়েছিল, কিন্তু জীবনকে জীবনের ভেতর থেকে বের করে নতুন জীবনের পথে পরিচালিত করার চেতনা তত প্রগাঢ়ভাবে কাজ করেনি। আজ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যদি, মানিক কিংবা তারাশঙ্কর পাঠ করা যায়, তাহলে তা কেবলই তার কালের মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে; এ ক্ষেত্রে বিভূতিকে কিছুটা এগিয়ে রাখা যায়, কারণ তার নির্মিত-জগত, একটি পত্নজগতের মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকার ক্ষমতা রাখে; আর চেতনাগতভাবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মৃত্যু নেই, যদিও তা সার্ত্রের অস্তিত্ববাদি দর্শনের অংশ।

পাশাপাশি নজরুলের তো বিদ্রোহী-সত্তার জন্য পুরস্কার প্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকার কথা; আর জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যে শক্তিমান ও গুরুত্বপূর্ণ কবি হলেও ইউরোকেন্দ্রিক, জীবনের শুরুতে (ঝরাপালক) নজরুলের অনুকৃতি, আর পরবর্তীকালে এলিয়ট, ইয়েটসসহ ইংরেজ কবিদের শব্দ ও বিষয় তার কবিতা নির্মাণে প্রধান অনুষঙ্গ হিসাবে এসেছিল। রবীন্দ্রনাথের একশ বছর পরে কারো নোবেল পাওয়ার জন্য কেবল সাম্রাজ্যবাদীতার অনুগমন নয়, রাবীন্দ্রিক আসুরিক ক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে যেতে হবে।

আর বর্তমান সময়ে এ দেশে কি একজনও কবি-সাহিত্যিক আছেন, যার চিন্তার স্বচ্ছতা মানবচেতনাকে পথ দেখাতে পারে। যুক্তির খাতিরে ধরা যাক, সৈয়দ শামসুল হক ও আল মাহমুদ; তাদের লড়াই কেবল বিপরীতমুখীনতাই নয়, ক্ষুণ্নিবৃত্তির প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিকতার দাসত্বে বাঁধা; যার পুরস্কার তারা নগদে আদায় করে নিচ্ছেন রাষ্ট্র কিংবা অদৃশ্য অনুগামীদের কাছ থেকে। সংখ্যালঘু, দুর্বল, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার এসব নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নাই, শিক্ষাও নাই। আর দৃশ্যত বাকিরা তাদের অবস্থান অধিকারের জন্য একই পথে দ্রুত ছুটছেন। নোবেল যদি সাম্রাজ্যবাদীদের পুরস্কার হয়, তাহলে সেই পুরস্কার তো আমাদের দেশের কবি-সাহিত্যিকরা তাদের এজেন্টদের কাছ থেকে প্রায়ই পাচ্ছেন, কষ্টের তো কারণ দেখি না!

Advertisement

এসইউ/জিকেএস