সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে ঢাক-ঢোল ও বাদ্যযন্ত্রের বিরাট হাট বসেছে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে। ঢাক-ঢোল ছাড়াও নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র ওঠে এই হাটে। তবে কোনো বাদ্যযন্ত্র বেচাকেনা হয় না এখানে। বাদ্যযন্ত্রের বাদকেরা অর্থের বিনিময়ে কেবল পূজা চলাকালীন আয়োজকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন।
Advertisement
কার চুক্তিমূল্য কত হবে, তা নির্ধারণ হয় ঢাকিদের দক্ষতার ওপর। পূজা উদযাপন কমিটির কর্তারা যাচাই করে নেন ঢাকিদের দক্ষতা। ৫০০ বছরের পুরোনো এ হাটে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে আগত বাদ্যদলকে ভাড়া করতে ভিড় করছেন বিভিন্ন এলাকার পূজারীরা। তাদের নিরাপত্তায় সতর্ক ভূমিকা পালন করছেন এলাকাবাসী ও পুলিশ।
সোমবার (৭ অক্টোবর) থেকে শুরু হওয়া এ হাট চলবে বুধবার (৯ অক্টোবর) সকাল পর্যন্ত।
ঢাক-ঢোল, কাঁসর, সানাই, বাঁশি, কর্তাল, খঞ্জরিসহ বাঙালির চিরচেনা সব বাদ্যযন্ত্রের পসরা সাজিয়ে হাটে বিক্রির উদ্দেশ্যে বাজনা বাজানোর নৈপুণ্য প্রদর্শনের মহড়ায় মেতে ওঠে এসব বাদক দল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা এসব বাদক দলকে পূজামণ্ডপের জন্য ভাড়া করতেও বিভিন্ন এলাকার পূজারিরা ভিড় করেন। ১০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ভাড়ায় মিলছে এসব বাদক দল। পাশেই পূজার ফুল পদ্মের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ফুল বিক্রেতারাও।
Advertisement
জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তার রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। কটিয়াদীর চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। একবার রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা ঢাকিদের সন্ধান করতে ঢাকার বিক্রমপুরের (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান। সেসময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকির দল পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাটে সমবেত হন। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নিতেন এবং পুরস্কৃত করতেন। সেই থেকেই যাত্রাঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু হয়। পরে এ হাট স্থানান্তর করে কটিয়াদীর পুরাতন বাজারের মাছ মহাল এলাকায় আনা হয়।
বাদক ও বাদ্যযন্ত্রের হাট ছাপিয়ে এটি এখন বাঙালির ঐতিহ্য ও মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। ‘তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’র অপূর্ব মূর্ছনায় মুখরিত হয়ে ওঠে আড়িয়াল খাঁ নদীপাড়ের প্রাচীন এই জনপদ।
নবাবগঞ্জ থেকে সাতজনের বাদক দল নিয়ে এসেছেন হরিরাজ। তিনি বলেন, ‘৩০ বছর ধরে কটিয়াদীর ঢাকের হাটে আসছি। এসময় সবাই আনন্দ করে কিন্তু আমাদের চলে আসতে হয় পরিবার ছেড়ে। বংশ পরস্পরায় এটি হয়ে এসেছে। পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে চলে আসি এই হাটে। আশা ঢাক বাজিয়ে পরিবারের জন্য নতুন কাপড় নিয়ে যাওয়ার। এবার হাটে ভালো টাকা বায়না পাবো আশা করছি।’
নরসিংদীর শিবপুর থেকে বাদ্যদল নিয়ে এসেছেন নিতাই। তিনি জানান, দুজনের দল নিয়ে এসেছেন। এবারের টার্গেট ২৫ হাজার টাকায় বাদ্য বাজাতে যাবেন। প্রতিবছর এই হাটের আশায় থাকেন তিনি।
Advertisement
নবাবগঞ্জ থেকে ছয়জনের দল নিয়ে এসেছেন বরুণ দাস। ১২ বছর ধরে তিনি এই হাটে আসছেন। বরুণ দাস বলেন, ‘এবার আমরা এক লাখ ২০ হাজার টাকা পূজায় বাদ্য বাজাতে যাবো।’
জেলার তাড়াইল উপজেলা থেকে বাদ্যদল বায়না করতে এসেছেন নিরঞ্জন সরকার। তিনি জানান, এই হাট থেকে প্রতিবছরই দুর্গাপূজার জন্য ঢাক-ঢোল বায়না করে নিয়ে যান। এবারও এসেছন। তবে এবার বাদক দলের দাম বেশি।
কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ঢাকির দল ভাড়া করতে এসেছেন দিপেন ভৌমিক। তিনি বলেন, ‘এই ঢাকের হাটের অনেক নাম শুনেছি। তবে এবারই প্রথম এলাম। ঢাকের হাট দেখা হলো, ঢাকি দল নেওয়াও হলো। তবে দাম মনে হচ্ছে একটু বেশিই।’
স্থানীয় কৃষ্ণধন গোস্বামী বলেন, ‘৫০০ থেকে ৭০০ বছর আগে থেকে এই ঢাক-ঢোলের চলে আসছে। আমরা এলাকাবাসী হিসেবে তাদের নিরাপত্তায় সবসময় কাজ করছি। তাদের যে কোনো সমস্যায় আমরা এগিয়ে আসি।’
কটিয়াদী পৌর পূজা উদযাপন পরিষদের সেক্রেটারি জনি কুমার সাহা জানান, হাটে বাদ্যদলের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ সসব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রতিবছর এখানে প্রায় ৬০০ ঢাকি আসেন। যারা অবিক্রিত থাকেন তাদের বাড়িতে যাওয়ার ভাড়া দিয়ে দেয় হাট কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে কটিয়াদী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, পূজার আয়োজক ও বাদকদের নিরাপত্তার জন্য কটিয়াদী মডেল থানা পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। ঢাকের হাটে পুলিশের একটি মোবাইল টিম কাজ করছে।
এসআর/এএসএম