কলসির আর হেলদোল হলো না। তখন কলেজে পড়তাম ব্যাপারটা এক রকম ছিল। কিন্তু এই বয়সে চ্যাংড়ামো করলে মানায়! ষোল-সতেরো বছর বয়সী ছেলেদের মতো সুযোগ পেলে মানুষের পেছনে লাগে। ওর কার্যকলাপ দেখে মেজাজটা মাঝে মাঝে এমন বিগড়ে যায় যে, কসন দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বাড়ির লোকদের জন্য পারি না। কলসির নামে বাড়ির সবাই ধসে। এক অবস্থা ফেসবুকেও। জনপ্রিয়তার কমতি নেই কলসির। কিছু লিখে পোস্ট করলে রিঅ্যাক্ট–কমেন্টের বন্যা বয়ে যায়। কেউ কেউ এ কারণে ঈর্ষা করে। ঈর্ষা থেকে সমালোচনাও করে অনেকে।
Advertisement
লাচুকাকু অবশ্য কলসিকে ঈর্ষা করেন না। ফেসবুকের রিঅ্যাক্ট-কমেন্ট নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। তিনি কলসির ওপর স্রেফ বিরক্ত। যদিও আমাদের কাকা-ভাইপোর সম্পর্ক কিন্তু বয়সের ব্যবধান বেশি নয়। কাকু রসিক মানুষ হলেও একটু চাপা স্বভাবের। সে কারণেই জিজ্ঞাসা করলেও কলসির ওপর বিরক্তির কারণটা বলেননি। মাঝে মাঝে আড্ডা দিতে কাকুদের বাড়িতে যাই। গেলে নানা বিষয়ে গল্প হয়। কবিতার ওপর ভালো দখল আছে তার। চাচাছোলা সমালোচনা করেন। নিজেও টুকটাক লেখার চেষ্টা করি। আগে নিয়মিত ফেসবুকে লিখতাম। কিন্তু ইদানীং কাকুর ভয়ে লিখছি না। কিছু লিখলে বানান ভুল, বিরামচিহ্ন ভুল, এটা হয়নি-সেটা হয়নি লিখে কাকু কমেন্ট করেন।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে মনটা এমনিতেই খচখচ করছিল। তার মধ্যে কলসি ফোন দিয়ে মেজাজটা আরও বিগড়ে দেয়। ‘ধূর, রাখ তো’ বলে একটা ‘ব’ বর্গীয় গালি দিয়ে কল কেঁটে দিই। মন ভালো হবে আশা নিয়ে আড্ডা দিতে কাকুদের বাড়িতে যাই। ছুটির দিন আজ। শুক্রবার। কাকু বারান্দার রকে বসে গান গাইছিলেন। আমাকে দেখে গান থামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ‘কী সৌভাগ্য, কী সৌভাগ্য, করুণ কবি যে!’ বলে জড়িয়ে ধরলেন। ব্যাঙ্গ করে তরুণ কবি না বলে করুণ কবি বলেন কাকু।
কথা হতে হতে মনে পড়ল, কাকু মেয়ে দেখতে গিয়েছিলেন। মেয়ে সুশ্রী, কবিতাপ্রেমী। দুই পরিবারও বিয়েতে রাজী। মেয়েও শুরুতে রাজী ছিল। কিন্তু হঠাৎ বেঁকে বসেছে। তার এখন একটাই দাবি, তাকে নিয়ে কবিতা লিখতে হবে। কাকুর মাও কম যান না, হবু বৌমার সুরে সুর মিলিয়ে বলেছেন, ‘ও বাবা লাচু, দু-চারটা কবিতাই তো! লিখে ফেলাবি, তাতে অতো ভাবা–ভাবির কী আছে, শুনি! সারাদিন তো কবিতার সঙ্গেই থাকিস, কবিতা কবিতা করিস। লিখে ফেলা দেখি বাপ…’। মুঠোফোনে কথাটা শুনে বলেছিলাম, ‘হঠাৎ করে এ দাবি কেন?’ কাকু জবাব দেননি, এঁড়িয়ে গিয়েছিলেন।
Advertisement
প্রশ্নটা পুনরায় করার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কবিতা লেখা হলো?’: লজ্জা দিচ্ছো, ভাইপো! জানো তো, আমি পড়তে ভালোবাসি। বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, দুই-একটা কবিতা হলে তাও না হয় চেষ্টামেষ্টা করে ঘষে-মেঝে দাঁড় করানো যেত। কিন্তু গোটা একটা কাব্যগ্রন্থ চেয়েছে। সব কবিতায় তাকে নিয়ে লিখতে হবে।: তা হঠাৎ এ দাবির কারণ?: তোমার প্রাণের বন্ধু কলসি। সব নষ্টের মূলে ওই শালা! শেষ করেছে আমারে।: কলসি, আশ্চর্য! : মেয়ে কলসির ফেসবুক ফ্রেন্ড। কলসির লেখার ভক্ত। কিছুদিন আগে কলসির একটা পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম। লিখেছিলাম, ‘কবিতা হয়নি, টবিতা হয়েছে হয়তো।’ সেই রাগ থেকে মেয়েকে বলেছে, আমি নাকি কবি, ছদ্মনামে লিখি। এখন যত বলি, যত বোঝাই সে তো মানতে চায় না। আর সেই সঙ্গে আমার মা-ও অতি উৎসাহী। বিয়ের কার্ড ছাপানো হয়ে গেছে। আত্মীয়-স্বজনরাও অনেকে কম-বেশি বিষয়টা জানে। কী যে করি মহা মুসিবদে পড়েছি, বুঝলে।
বলে বোতল থেকে ঢোক ঢোক করে জল খেলেন। খারাপ লাগলো। কলেজ জীবনে আমার উতলে ওঠা প্রেমটাও কলসি গ্লুট করে ভেস্তে দিয়েছিল। সময় নষ্ট না করে কলসির কাছে যাই। আমাকে দেখতে পেয়েই জিজ্ঞাসা করে, ‘দোস্ত খবর কী, যন্ত্রপাতি সব কুশল তো?’ : লাচুকাকুর সঙ্গে কাজটা কেন করলি?: আমি কিছু করিনি। আর কিছু করলেও তোর কী?ইচ্ছে করছিল একটা ঘুষি দিয়ে নাকটা বোচা করে দিই। কিন্তু নিজেকে সামলে নিই।
দুই. মুঠোফোন বাজছে। লাচুকাকু কল করেছেন। বেশ কিছুদিন বাড়িতে ছিলাম না। তাৎক্ষণিক ঢাকায় যেতে হয়েছিল। যদিও ভেবে রেখেছিলাম একদিনের জন্য হলেও বইমেলায় যাবো। কিন্তু বইমেলার আগের দিন জামাইবাবু কল করে বললেন, ‘শালাবাবু, বই বের করছি, উপন্যাস। চলে আসো।’ ভেবেছিলাম, বই তেমন চলবে না। দিদির বিয়ে হয়েছে দশ বছর। জামাইবাবু লেখালেখি করেন, আগে কখনো শুনিনি। এমনকি বই পড়তেও দেখিনি কখনো। মেলার সময়ে স্টলেও ছিলাম। তেমন কাঁটতিও চোখে পড়েনি। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে অনলাইনে বেশি বিক্রির তালিকায় আছে বইটি।বাড়ি ফেরার সময় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘জামাইবাবু কীভাবে সম্ভব হলো?’: ম্যাজিক। তোমার বই বের হোক তখনও ম্যাজিক হবে।তখনই ভেবে রেখেছিলাম, বিষয়টা নিয়ে লাচুকাকুর সঙ্গে আলাপ করবো। কাকুর জানাশোনা অনেক। নিশ্চয়ই বিষয়টা খোলাসা করতে পারবেন।
কল রিসিভ করতেই ভালো-মন্দ কথা শেষে বেদনাজড়ানো কণ্ঠে কাকু বললেন, ‘গরিবের কথা কি মনে পড়তে নেই! সন্ধ্যায় একটু আসতে পারো গরিবের ভিটেয়?: দেরি হতে পারে, তবে যাবো।
Advertisement
তিন. পূর্ণিমা তিথি চলছে। চারপাশে ঠিকরে পড়ছে চাঁদের আলো। লাচুকাকুদের সদ্য রং করা বাড়ির দেওয়ালে দুটো ছেলে আঁকিবুকি করছে। চোখাচোখি হতেই তারা সটকে পড়লো। মোবাইলের ফ্লাশ দেওয়ালের ওপর ফেলতেই হাসি পেলো। ‘এটা দাদুর বাড়ি, দাদুর সঙ্গে কখনো করবো না আড়ি’ লেখা। পাড়ার ছেলেরা লাচুকাকুকে দাদু বলে ডাকে। ওদেরই কাজ, বুঝতে কষ্ট হলো না।
দ্রুত হেঁটে লাচুকাকুর ঘরের সামনে গেলাম। কাকু দৌঁড়ে এসে ঘরে নিয়ে গেলেন। টেবিলের ওপর থরে থরে বই সাজানো। আমাকে বসতে বলে ভেতরের ঘরে গেলেন কাকু। নাস্তার ট্রে হাতে হাসিমুখে এসে বললেন, ‘খোশ-খবরি আছে। খেলা তো ফাইনাল হয়ে গেছে।’: কিন্তু কবিতা?কথার রেশ ফুরোতে না দিয়ে টেবিলের ড্রয়ার টেনে এক সেট প্রিন্ট করা কাগজ দিলেন হাতে। চোখে চোখ রেখে লজ্জাবনত হাসি হাসলেন। পাণ্ডুলিপি! উৎসর্গপত্রে লাচুকাকু লিখেছেন, ‘সবিতা, প্রিয়তমা আমার। তোমার জন্য আজ আমি কবি। আমার সব কবিতা তোমাকে দিলাম।’ : দেড় মাসে কাব্যগ্রন্থের সব কবিতা লিখে ফেললেন! এ অসাধ্য কীভাবে সম্ভব হলো?: ম্যাজিক। ঠিক করেছি ‘কবি হওয়ার সহজ উপায়’ শিরোনামে একটা বই লিখবো।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। একটি ম্যাজিকের সমাধান জানতে গিয়েছিলাম। চাঁদের আলোয় আরও একটি ম্যাজিকের সাক্ষী হয়ে বাড়ি ফিরলাম। এখন কেবল ‘কবি হওয়ার সহজ উপায়’ বইটা হাতে পাওয়ার অপেক্ষা…
এসইউ/জিকেএস