অর্থনীতি

শেয়ারবাজার সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের সার্বিক উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মানে শেয়ারবাজারের সুশাসন নিশ্চিতের পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষ শেয়ারবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

Advertisement

সোমবার (৭ অক্টোবর) বিএসইসি থেকে এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এতে সই করেছেন বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ।

টাস্কফোর্সের সদস্যরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোংয়ের সিনিয়র অংশীদার এ এফ এম নেসার উদ্দীন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক মো. মোস্তফা আকবর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন।

টাস্কফোর্স অবিলম্বে কার্যক্রম শুরু করবে এবং সংশ্লিষ্ট সবপক্ষের মতামত বিবেচনা করে একটি যৌক্তিক সময়ে প্রস্তুত করা প্রতিবেদন (বিদ্যমান কাঠামো পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সংশোধনী প্রস্তাব, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণের নিমিত্ত সুপারিশ প্রদানসহ অন্যান্য বিষয়াদি) বিএসইসির কাছে হস্তান্তর করবে বলে নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে।

Advertisement

বিএসইসির সুপারিশের ভিত্তিতে টাস্কফোর্সের কার্যালয় নির্ধারিত হবে। বিএসইসিসহ শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান যেমন- ডিএসই, সিএসই, সিডিবিএল, সিসিবিএল-সহ বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এবং অন্যান্য পক্ষ টাস্কফোর্সের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সরবরাহসহ সব ধরনের সহযোগিতা দেবে- বলে নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, পরবর্তীতে কমিশন প্রয়োজনে উপযুক্ত ব্যক্তিকে টাস্কফোর্সের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। বিএসইসি এ টাস্কফোর্সকে সাচিবিক সহায়তা দেবে।

টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি

শেয়ারবাজারের উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করার এই টাস্কফোর্স যে কার্যক্রম পরিচালনা করবে তার মধ্যে রয়েছে-

>> বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের আকার তথা 'জিডিপি ও বাজার মূলধন'-এর অনুপাত কম হওয়ার প্রধান কারণগুলো চিহ্নিত করে উত্তরণের জন্য সরকারের আর্থিক খাতের নীতি প্রণয়নের প্রস্তাবনা।

Advertisement

>> দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে ব্যাংক ঋণের পরিবর্তে শেয়ারবাজার থেকে অর্থায়নের জন্য সরকারের আর্থিক নীতি প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কমিশনের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য সুপারিশ প্রণয়ন করা।

>> আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শেয়ারবাজারের সুশাসন উন্নীতকরণের লক্ষ্যে শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি এবং প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্লেষণ করা ও সমাধানের সুপারিশমালা প্রণয়ন।

>> বিএসইসির প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা শক্তিশালীকরণ, অভ্যন্তরীণ সুশাসন, অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে প্রযুক্তি ও অটোমেশনের প্রয়োগ, তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অন্যান্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রশাসনিক কাঠামোর সুপারিশ, মানব সম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধি, কমিশনের কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, সেমিনার, কর্মশালায় অংশগ্রহণ-সহ অভ্যন্তরীণ অন্যান্য বিষয়ে সুপারিশ প্রদান।

>> ডিএসই, সিএসই, সিডিবিএল, সিসিবিএলের তদারকি কার্যক্রম বিশ্বমানে উন্নীতকরণসহ উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে যুগোপযোগীকরণের সুপারিশ প্রণয়ন।

>> প্রাইভেট প্লেসমেন্ট/অফারের মাধ্যমে ইক্যুইটি সিকিউরিটিজ ইস্যু সংক্রান্ত সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (ইস্যু অফ ক্যাপিটাল) রুলস, ২০০১ যুগোপযোগীকরণের সুপারিশ প্রণয়ন।

>> তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন, করপোরেট ডিজক্লোজার, নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের সঠিকতা নিশ্চিতকরণসহ করপোরেট গভর্ন্যান্স, বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা এবং বাজারের গভীরতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন।

>> ডেট ও ইক্যুইটি সিকিউরিটিজ ইস্যুর আবেদনের ক্ষেত্রে দাখিল করা তথ্য-উপাত্ত, দলিল-দস্তাবেজ, সম্পদ পুনঃমূল্যায়ন প্রতিবেদন, নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে প্রস্তুতকারী পক্ষসমূহ যেমন: ইস্যুয়ার কোম্পানি, ইস্যু ম্যানেজার ও আন্ডার রাইটার (মার্চেন্ট ব্যাংকার), ভেল্যুয়ার এবং অডিটরসহ অন্যান্য পক্ষগুলোর দায়দায়িত্ব ও সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন।

>> বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে এতদসংশ্লিষ্ট বিধিমালা যেমন- সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন (মার্চেন্ট ব্যাংকার ও পোর্টফলিও ম্যানেজার) বিধিমালা, ১৯৯৬, সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন (স্টক- ডিলার, স্টক-ব্রোকার ও অনুমোদিত প্রতিনিধি) বিধিমালা, ২০০০, সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন (মিউচ্যুয়াল ফান্ড) বিধিমালা, ২০০১-সহ সংশ্লিষ্ট বিধিমালা যুগোপযোগীকরণের সুপারিশ প্রণয়ন।

>> ডেট ও ইক্যুইটি সিকিউরিটিজ ইস্যু সংক্রান্ত বিধি-বিধানের যেমন- বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু) রুলস ২০১৫, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (রাইট ইস্যু) রুলস, ২০০৬, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (ডেট সিকিউরিটিজ), রুলস ২০২১, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (ইনভেস্টমেন্ট সুকুক), বুলস ২০১৯, বিএসইসি (সম্পদ ভিত্তিক সিকিউরিটি ইস্যু) বিধিমালা, ২০০৪-সহ সংশ্লিষ্ট বিধিমালা যুগোপযোগীকরণের সুপারিশ প্রণয়ন।

>> বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও আস্থা বৃদ্ধির লক্ষ্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে নিয়মিত পরামর্শ ও সমন্বয়ের গাইডলাইন এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়ন।

>> বাজারে কারসাজি, সুবিধাভোগী ব্যবসায় লেনদেন ও অন্যান্য অনিয়মের বিচার ও জরিমানায় সমতা আনয়নের জন্য বিদ্যমান আইনের শাস্তির ধারার অধীনে একটি সুনির্দিষ্ট পেনাল কোড বা শান্তির বিধিমালা প্রণয়ন করা।

>> মার্কিন রুলস, ১৯৯৯ যুগোপযোগীকরণসহ, বিদ্যমান ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কৌশল এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও বিজনেস ইন্টেলিজেন্স মডিউল সমৃদ্ধ বিশ্বমানের অনলাইন ও অফলাইন সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম বা বাজার তদারকি ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিরূপণ ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশ প্রণয়ন।

>> বর্তমান বাজার কাঠামোর মূল্যায়ন, বাজারের গভীরতা ও পণ্য বৈচিত্র্যকে বিবেচনা করে দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কীভাবে আরও আকৃষ্ট করা যায় সেই কৌশল প্রণয়নে প্রয়োজনীয় সুপারিশ।

>> শেয়ারবাজারের কার্যক্রমে অটোমেশন বৃদ্ধির মাধ্যমে শেয়ারবাজারের সুশাসন এবং বিনিযোগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও উন্নয়ন এবং শেয়ারবাজার উপযোগী ফিনটেক টেকনোলজি প্রচলন এবং শেয়ারবাজারের প্রযুক্তিগত সংবেদনশীলতা বিবেচনায় নিয়ে সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিত করার জন্য সুপারিশ প্রণয়ন।

>> নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর (বিএসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক, আইডিআরএ, এমআরএ, এনবিআর, আরজেএসসি ইত্যাদি) সাথে সমন্বয় সাধনের উপায় নির্ধারণে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি বা নির্দেশিকা প্রণয়ন।

>> তালিকাভুক্ত কোম্পানির সাথে অতালিকাভুক্ত কোম্পানি বা তালিকাভুক্ত কোম্পানির মার্জার, আমালগামেশন, একুইজেশনের মাধ্যমে কোনো শেয়ার ইস্যু সংক্রান্ত বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টে এতদসংক্রান্ত স্কিম অনুমোদনের আগে বিএসইসি হতে অনাপত্তিপত্র গ্রহণ বিষয়ে সুপারিশমালা প্রণয়ন।

>> এছাড়া টাস্কফোর্সের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সমন্বয়/সংযোজন করা যাবে।

টাস্কফোর্সের গঠন

নির্দেশনায় টাস্কফোর্স গঠেনর কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের সার্বিক উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি, শেয়ারবাজারের আন্তর্জাতিক মানের সুপারিশ অর্জনের লক্ষ্যে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, শেয়ারবাজারের অংশীজনদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংগঠন (ডিবিএ, বিএমবিএ, এসিআরএবি, বিএপিএলসি), অর্থনীতিবিদ, পেশাদার (চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট, চার্টার্ড সেক্রেটারি প্রভৃতি), বিনিয়োগকারী ইত্যাদি ব্যক্তিদের সুচিন্তিত মতামত ও সুপারিশের ভিত্তিতে বিএসইসি ‘শেয়ারবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স’ গঠন করেছে। এ টাস্কফোর্সের মাধ্যমে বাজারের প্রধান প্রধান দিকগুলো বিশ্লেষণ, প্রয়োজনীয় সংস্কার, পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ প্রণয়ন করা হবে। বর্তমান বাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং একটি টেকসই শেয়ারবাজার গঠনের জন্য এই টাস্কফোর্স অপরিহার্য।

দক্ষ শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, নিরীক্ষক, প্রযুক্তিবিদ ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের কাজের অভিজ্ঞ সদস্যদের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হলো। পরবর্তীতে কমিশন টাস্কফোর্সের আকার ও পরিধি চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তন করতে পারবে। টাস্কফোর্সের অধীনে গঠিত ফোকাস গ্রুপে শেয়ারবাজারের বিশেষজ্ঞ এবং পরামর্শক, নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিনিধিরা, বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের দক্ষ পেশাজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, বিশ্লেষক এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার-সহ অন্যান্য ব্যক্তিরা সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন।

ফোকাস গ্রুপ গঠন

টাস্কফোর্সের অধীনে বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক ফোকাস গ্রুপ থাকবে। প্রতিটি ফোকাস গ্রুপ নির্দিষ্ট বিষয়ে কাজ করবে এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে টাস্কফোর্সকে সুপারিশ দেবে। কমিশন অবহিত করে টাস্কফোর্স উপযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ফোকাস গ্রুপ গঠন করবে।

এমএএস/এমএএইচ/এমএস