জাতীয়

তিন হাজার কোটি টাকায় সড়ক সংস্কার, বছর না যেতেই বেহাল

ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের সংস্কার ও উন্নয়নকাজ শেষ করতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) লেগেছিল পাঁচ বছর। নির্মাণকাজের ধীরগতির কারণে মানুষের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। কিন্তু দুই বছর না যেতেই চট্টগ্রামের ‘লাইফ লাইন’ পোর্ট কানেকটিং সড়কে (পিসি রোড) এখন বড় বড় গর্ত। বন্দরের পণ্যবাহী যান চলাচলের প্রধান সড়কটি এখন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

Advertisement

শুধু পিসি রোড নয়, এ অবস্থা নগরের বেশিরভাগ সড়কের। কার্পেটিং উঠে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় খানাখন্দের। এসব সড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলছে, ঘটছে দুর্ঘটনা।

বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রাম নগরের ৩৬টি ওয়ার্ডের ৩২২টি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০ কিলোমিটার। তালিকা তৈরির দুই মাস পার হলেও এখনো সংস্কার শুরু করতে পারেনি চসিক।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, নগরের সড়ক সংস্কারে গত সাত বছরে ছয়টি প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে পাঁচটি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। এসব প্রকল্পের আওতায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা হয়েছে ৬৮৭ কিলোমিটার সড়ক। এছাড়া গত ছয় অর্থবছরে নিজস্ব অর্থায়নে রাস্তা, ফুটপাত ও সংস্কারের কাজে ব্যয় করা হয়েছে ২৭৪ কোটি টাকা। কিন্তু সংস্কারের পর এক বছর না পেরোতেই সড়কগুলো বেহাল হয়ে পড়ে।

Advertisement

সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতায় নগরের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৬টি ওয়ার্ডের ৩২২টি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০ কিলোমিটার। তবে তালিকা তৈরির দুই মাস পার হলেও এখনো সংস্কার শুরু করতে পারেনি চসিক।

আরও পড়ুন সোয়া ৩ কোটির কাজে ৬১ লাখ টাকা ঘুস, চসিকের ২ প্রকৌশলী ওএসডি  ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ১৪ বছর পর শুরু হলো নির্মাণকাজ 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুল অর্থ ব্যয়ে সংস্কারের পরও নিম্নমানের কাজ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ঠিক না থাকায় এক মৌসুমেই সড়কের এই দশা হয়েছে।

সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহীন উল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিপুল অর্থ ব্যয়ে সংস্কার হওয়া সড়কের এই পরিণতির কারণ বর্ষায় জলাবদ্ধতা। বিটুমিনের রাস্তায় পানি জমে থাকলে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। এবার সংস্কার কাজের মান নিশ্চিত করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। চুয়েট থেকে সড়কের নকশা নেওয়া হচ্ছে।

বিপুল অর্থ ব্যয়ে সংস্কার হওয়া সড়কের এই পরিণতির কারণ বর্ষায় জলাবদ্ধতা। বিটুমিনের রাস্তায় পানি জমে থাকলে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। এবার সংস্কার কাজের মান নিশ্চিত করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। চুয়েট থেকে সড়কের নকশা নেওয়া হচ্ছে।-চসিকের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহীন উল ইসলাম চৌধুরী

Advertisement

সরেজমিনে দেখা যায়, সদরঘাট থেকে বারিক বিল্ডিং মোড় পর্যন্ত স্ট্র্যান্ড রোডে বড় বড় গর্ত। গুরুত্বপূর্ণ সড়কটির বেশিরভাগ অংশে বিটুমিন উঠে গর্তের সৃষ্ট হয়েছে। সড়কের বিটুমিন ধুয়ে-মুছে গিয়ে নুড়িপাথর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এর মধ্য দিয়ে যাত্রীবাহী যানবাহনের পাশাপাশি বন্দরের পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, লরি, ট্রেইলার ও প্রাইমমুভার হেলেদুলে চলছে।

সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে জাইকার অর্থায়নে দুটি প্যাকেজে প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে এই স্ট্র্যান্ড রোডের উন্নয়ন কাজ করা হয়েছিল।

স্থানীয় বাসিন্দা কবির সিকদার বলেন, সড়কটি এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন পর পর সংস্কার করা হয়, কিন্তু টেকসই কাজ হয় না। নিম্নমানের কাজের কারণে সড়কটি বারবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জীবন হাতে নিয়ে এ সড়ক দিয়ে চলাচল করে লোকজন।

‘আমাদের দেশে এখনো পুরোনো নিয়মে বিপুল টাকা খরচ করে সড়ক সংস্কার করা হয়। কিন্তু টেকসই করার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বর্ষা মৌসুমে তাড়াহুড়া করে সড়কের সংস্কার করা হয়। কাজের মানও হয় খারাপ। কাজের মান ঠিক রেখে নির্মাণ করা হলে পিচ ঢালাইয়ের সড়ক ১০ বছর টেকসই হওয়ার কথা।’- অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম

স্ট্র্যান্ড রোড সংস্কারে দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার জাহান বলেন, স্ট্র্যান্ড রোডটি চসিকের আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় আবারও সংস্কার করা হবে। প্রকল্পের নকশা তৈরির কাজ চলছে। সড়কটিতে যেসব গর্ত হয়েছে, সেগুলো মেরামতে কাজ করা হচ্ছে। স্থায়ী ও টেকসইভাবে সড়কটি সংস্কারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এদিকে বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় বেহাল নগরের মুরাদপুর থেকে অক্সিজেন সড়ক। এই সড়কের মুরাদপুর, রেলবিট, বিবিরহাট, হামজারবাগ, সংগীত, আতুরার ডিপো, রউফৌবাদ, অক্সিজেনসহ একাধিক স্থানে খানাখন্দে ভরপুর। সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। চরম ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। বৃষ্টি হলে এই সড়কে চলাচলকারী লোকজনের দুর্ভোগ বেড়ে যায় কয়েকগুণ।

একই অবস্থা নগরের অক্সিজেন থেকে কুয়াইশ মোড় পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার সড়কের। বহদ্দারহাট থেকে ওয়াসা মোড় পর্যন্ত সড়কের অবস্থাও বেহাল। বিশেষ করে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি (বাওয়া) স্কুলের সামনে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্প তৈরির জন্য খোঁড়া গর্তে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রতিদিন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে হাজারো শিক্ষার্থী।

এদিকে নগরের মেরিনার্স সড়ক, জামালখান সড়ক, শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ সড়ক, সিডিএ অ্যাভিনিউ, শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়ক, আরাকান সড়ক, ঢাকা ট্রাঙ্ক (ডিটি) রোড, হালিশহর সড়ক, কাপাসগোলা সড়ক ও আলকরণ রোড বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, ‘আমাদের দেশে এখনো পুরোনো নিয়মে বিপুল টাকা খরচ করে সড়ক সংস্কার করা হয়। কিন্তু টেকসই করার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বর্ষা মৌসুমে তাড়াহুড়া করে সড়কের সংস্কার করা হয়। কাজের মানও হয় খারাপ। কাজের মান ঠিক রেখে নির্মাণ করা হলে পিচ ঢালাইয়ের সড়ক ১০ বছর টেকসই হওয়ার কথা।’

এএজেড/এমএইচআর/এমএমএআর/জিকেএস