বৃদ্ধ ফাতেমার বয়স ৬৫ পেরিয়েছে। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না। কিন্তু পেটতো আর বসে থাকে না। অগত্যা এই শরীর নিয়েই রেললাইনের পাশে বসেছেন কুড়িয়ে আনা সবজি বিক্রি করতে। ছোট্ট প্লাস্টিকের বস্তার ওপরে সাজিয়েছেন আদা, রসুন, পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচ। ক্রেতাদের ডাকছেন ‘বাবা-শোনা’ বলে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে যারা কাছে যাচ্ছেন তারাও ছিন্নমূল দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। দু-চার টাকা কমে কিনতে পাবেন এই আশায় সাড়া দিচ্ছেন বৃদ্ধা ফাতেমার ডাকে।
Advertisement
রোববার (৬ অক্টোবর) কথা হয় ফাতেমাসহ আরও কয়েকজন সবজি বিক্রেতার সঙ্গে। তাদের জীবনের গল্পটাও অভিন্ন। প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই জাগতে হয় তাদের। এরপরই শুরু হয় বেঁচে থাকার জন্য জীবন সংগ্রাম।
ফাতেমার বাড়ি বগুড়া সদরের উত্তর চেলোপাড়ায়। তিনি ভাড়া বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে আসেন রাজাবাজারে। বাজারে পৌঁছেই ছুটে যান আড়তগুলোতে। সেখানে পাইকাড়ি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের পানি সরবরাহ, দোকানের বর্জ্য পরিষ্কার, কাঁচামাল বাছাইয়ে সহযোগিতা করেন। বিনিময়ে তারা কিছু টাকা দেন। আবার অনেকের কাছে পান সবজি, তরিতরকারি। খুব ভোরে করতে হয় এই কাজ।
তারপর শুরু হয় গুদামে নেওয়ার সময় বস্তা থেকে পড়ে থাকা সবজি ও তরিতরকারি কুড়ানোর কাজ। এভাবে বাজার ঘুরে যা সংগ্রহ হয় তাই নিয়ে বসে পড়েন উত্তর চেলোপাড়া রেলসেতুর পাশে। কাছে জমানো আইটেমগুলো আকারভেদে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করেন। স্থানীয়ভাবে এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘ভাগা লাগানো’। এরপর প্রতিটি ভাগা ১০-২০ টাকায় বিক্রি করতে বসেন। সারাদিন ধরে চলে এই কাজ।
Advertisement
ফাতেমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ায় আমার একার আয়ে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে না। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। একমাত্র ছেলে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে থাকে। ওরা আমার কোনো খোঁজখবর রাখে না। অথচ বাজারে সব কিছুরই দাম বেশি। শরীরের তেমন একটা শক্তি নেই যে মানুষের বাসায় কাজ করবো। মাসে এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া দিতে হয়। খাওয়ার খরচ, ওষুধ কেনাতো আছেই। এসবের জোগান দিতে সবজি বিক্রি করি।’
তিনি আরও বনে, ‘মাঝে মাঝে কম দামেও কাঁচামাল কিনে বিক্রি করি। আবার বড় বড় পাইকারি দোকানগুলোতে পরিষ্কারের কাজে সাহায্য করলেও তারা কিছু সবজি দেয়।’
এই সবজি কারা কেনেন এমন প্রশ্নের জবাবে বৃদ্ধা ফাতেমা বলেন, ‘আমার মতো অনেক মানুষ আছে যারা এইগুলো কিনে থাকেন। আবার কখনো বড় বাবুরাও কেনেন। আবার কোনোদিন বিক্রিও হয় না। তখন অনেক সবজি নষ্ট হয়ে যায়। নয়তো আমি বাসাই নিয়ে সেগুলো রান্না করি। এভাবে দুঃখ-কষ্টে চলে আমার জীবন।’
রহিমা নামের একজন ক্রেতা বলেন, ‘তাদের মতো আমরাও অসহায়। আমরা স্বল্প দামে তাদের কাছ থেকে কিনতে পারি। মোটামুটি ভালোমানের সবজি বিক্রি করে তারা। তাদের বয়সে অনেক মানুষ আছে ভিক্ষাবৃত্তি করে খায়। সেখানে এরা কর্ম করে খাচ্ছেন। এটাতো প্রশংসনীয়।’
Advertisement
উত্তর চেলোপাড়ার বাসিন্দা রাজু আহম্মেদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি তারা এই কাজ করছেন। তাদের খোঁজ নেওয়ার মতো কেউ নেই। এই বয়সে অন্য কিছু করার সামর্থ্যও নেই। আমি মনে করি সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদের কিংবা সমাজসেবা থেকে তাদের যদি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যেতো তাহলে ভালো হতো।’
এ বিষয়ে বগুড়া সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আবু সাঈদ মোহাম্মাদ কাওছার রহমান বলেন, যদি তাদের বয়স ৬২ বছরের কম হয়, তাহলে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে সহযোগিতা করা যাবে। আর যদি বেশি হয় এবং তারা যদি বয়স্ক ভাতা না পেয়ে থাকেন, তাহলে পর্যায়ক্রমে তাদের বয়স্কভাতার আওতায় আনা হবে।
এসআর/জেআইএম