পাঁচ বছরেও চালু হয়নি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ১৪৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ২৭ লাখ ৯৩ হাজার টাকার ১৪৭টি বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন। স্লিপের টাকায় স্থাপনের পর একদিনও ব্যবহার না হওয়ায় ধুলা, বালি জমে কতগুলো মেশিন আবার নষ্টও হয়েছে। মেশিন কেনাকাটায়ও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।
Advertisement
অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কুমারখালী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামছুজ্জামান অরুন তার পুত্র অর্ণব কিবরিয়া প্রতীকের কাছ থেকে ‘রিয়েল টাইম’ ব্র্যান্ডের আর এস ২০ বি মডেলের বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কেনার নির্দেশ দেন। প্রতিটি মেশিনের বাজারমূল্য ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা হলেও মেয়রপুত্র নামসর্বস্ব ‘প্যাসিফিক এন্টারপ্রাইজ’ ও ‘টারডো কম্পিউটার’ নামক প্রতিষ্ঠানের ভুয়া ভাউচার ব্যবহার করে ১৯ থেকে ২০ হাজার টাকা করে বিল তুলে নেন।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ -২০১৯ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্লিপের টাকায় বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে বাজার যাচাই বাছাই করে সাশ্রয়ী মূল্যে মেশিন কিনে স্থাপন করবে। এর কোনো ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তবে মন্ত্রণালয়ের সেই নির্দেশনা ভেস্তে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মেয়রপুত্র অর্ণব কিবরিয়া প্রতীক। তিনি ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে জোরপূর্বক তার লোকজন দিয়ে বিদ্যালয়গুলোতে ‘রিয়েল টাইম’ ব্র্যান্ডের ‘আর এস ২০ বি’ মডেলের বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন স্থাপন করেন। এবং ঢাকার তেজগাঁও এলাকার ঠিকানা ব্যবহার করে ‘প্যাসিফিক এন্টারপ্রাইজ’ ও কুমারখালী বাসস্ট্যান্ড এলাকার ‘টারডো কম্পিউটার’ নামক প্রতিষ্ঠানের ভুয়া ভাউচার ব্যবহার করে এক একটি ১৯ থেকে ২০ হাজার টাকা করে বিল তুলে নেন। ভাউচারের ঠিকানায় মেয়রপুত্র নিজের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করেন।
Advertisement
তবে মেশিন কেনার পর একদিনও ব্যবহার করা হয়নি। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় অনেক মেশিন নষ্ট হওয়ার উপক্রম।
জানতে চাইলে রিয়েল টাইম কোম্পানির হটলাইনের এক কর্মকর্তা জানান, আর এস ২০ বি মডেলের বায়োমেট্রিক মেশিনটি আপাতত স্টকে নেই। সেসময় প্রতিটি মেশিন ৬ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করা হতো।
কুমারখালী টারডো কম্পিউটারের স্বত্ত্বাধিকারী লিটন আব্বাস বলেন, তিনি কোনোদিন বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কেনাবেচা করেননি। তার দোকানের ভাউচার নকল করে বিল করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
উপজেলার পৌরসভা, যদুবয়রা, জগন্নাথপুর, সদকী, পান্টি, নন্দলালপুর ও চাপড়া ইউনিয়নের প্রায় ৫৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষকদের কার্যালয়ে দরজার পাশের দেওয়ালে কালো রঙের বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। তাতে ধুলো-বালি জমে মাকড়শা বাসা বেঁধেছে। অচল অবস্থায় পড়ে আছে। আর সার্ভার মেশিনটি রাখা হয়েছে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ে। তার ওপর রাখা রয়েছে কাগজপত্রাদির স্তূপ।
Advertisement
স্লিপের টাকা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যাচাই বাছাই করে খরচ করবে বলে জানিয়েছেন বজরুক দুর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মাহবুবুল আলম।
তিনি বলেন, আমি বাজার যাচাই করে হাজিরা মেশিন কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মেয়র ফোন দিয়ে বলেন, তার ছেলের কাছ থেকে নিতে।
তার ভাষ্য, মেয়রপুত্র লোক পাঠিয়ে মেশিন লাগিয়ে ১৯ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। যদিও মেশিনটি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় কেনা যেত।
বানিয়াকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) শাহানারা পারভীন বলেন, ১৯ হাজার টাকা নিয়ে মেশিন লাগিয়ে গেছে। একদিনও চলেনি, নষ্ট।
অভেদানন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাছরিন আক্তার বলেন, সহকারী শিক্ষক দ্বিপেন্দ্রনাথ পালের মাধ্যমে টারবো কম্পিউটার থেকে মেশিনটি আমরাই কিনেছি। তবে লাগিয়েছিল মেয়রের লোকজন।
আর সহকারী শিক্ষক দ্বিপেন্দ্রনাথ পাল বলেন, স্লিপের টাকায় ২০ হাজার টাকায় মেশিন কেনা হয়। সাপ্লাই দিয়েছিল মেয়রপুত্র প্রতীক।
এ বিষয়ে জানতে ‘প্যাসিফিক এন্টারপ্রাইজের’ ভাউচারে থাকা ফোন নম্বরে কল দেওয়া হয়। কল রিসিভ করেন মেয়রপুত্র অর্ণব কিবরিয়া। তিনি বলেন, রং নম্বর। প্যাসিফিক এন্টারপ্রাইজ বলে কিছু নেই বলে ফোনটি কেটে দেন। এরপর বারবার কল দিলেও তিনি আর রিসিভ করেননি।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৪৭টি বিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কেনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা খন্দকার শরিফুল ইসলাম।
তিনি জানান, স্লিপের টাকা সাধারণত প্রধান শিক্ষকসহ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাজার যাচাই করে খরচ করার কথা। কিন্তু সেসময় কিছুটা ব্যত্যয় ঘটেছিল। মূলত শিক্ষক-কর্মকর্তারা রাজনৈতিক প্রেসারে মেয়রপুত্র ও আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে প্রতীকের প্রেসারে পড়ে মেশিনগুলো ক্রয় করে। যাচাই বাছাইয়ের সুযোগ পায়নি। এতে কিছুটা অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে।
কুমারখালীতে যোগদানের পূর্বেই মেশিনগুলো স্থাপন করা হয় বলে জানিয়েছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, মেশিনগুলো কোনোদিনও ব্যবহার হয়নি। অকেজো হয়ে পড়ে আছে। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে তা সচল করা হবে।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগের পর থেকে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মেয়র সামছুজ্জামান অরুন। তার ফোনটিও বন্ধ রয়েছে। সেজন্য বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আল-মামুন সাগর/এফএ/এমএস