দেশজুড়ে

উৎপাদন বাড়লেও বিক্রি নেই, সুগন্ধি চাল নিয়ে বিপাকে ব্যবসায়ীরা

সুগন্ধি চালের পথিকৃৎ দিনাজপুর জেলায় সুগন্ধি চাল বিক্রিতে ধস নেমেছে। গত আমন ও বোরো দুই মৌসুমে চাল বিক্রি করতে না পারায় শত শত মেট্রিক টন চাল পড়ে রয়েছে অবিক্রিত অবস্থায়।

Advertisement

এদিকে আর একমাস পরই বাজারে আসবে আমন মৌসুমের সুগন্ধি চাল। এ অবস্থায় সুগন্ধি চাল রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন দিনাজপুরের মিলার ও চাল ব্যবসায়ীরা। সামনের আমন মৌসুমের আগেই মজুত চাল বিক্রি করতে না পারলে সুগন্ধি চাল ব্যবসায়ীদের ধস নামবে বলে আশঙ্কা মিলার ও ব্যবসায়ীদের।

দিনাজপুরের সুগন্ধি চালের বাজার ও মিলার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুগন্ধি চালের বেচাকেনা তলানীতে নেমেছে। অনেক মিলার ও বড় ব্যবসায়ী বহনীও করতে পারছেন না। সুগন্ধি চিনিগুড়া এক মণ (৪০ কেজি) চাল গত আমন সৌমুমে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিল, সেই চাল বোরো মৌসুমে এসে ৪ হাজার টাকা মণ বিক্রি হয়। সেই চিনিগুড়া চাল এখন পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৩৩০০ টাকায়। ৯০ জিরা বিক্রি হচ্ছে ২৪০০ টাকা ও কাটারী ২৩০০ থেকে ২৩৫০ টাকায়।

গত দুই মৌসুমের ব্যবধানে সুগন্ধি চালের দাম প্রকারভেদে এক মণে ১৭০০ থেকে ১০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত কমে গেছে। তারপরও বিক্রি নেই। মিলার এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাকিতে বিক্রির শর্তেও চাল বিক্রি করতে পারছেন না। দোকানীরা সুগন্ধি চাল কিনছেন না।

Advertisement

এ ব্যাপরে জানতে চাইলে বাহাদুর বাজারের চাল ব্যবসায়ী মেসার্স বি কে ট্রেডার্সের মালিক বিশ্বজিত কুন্ডু বিশু বলেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠান কমে গেছে, বিয়ের অনুষ্ঠানও খুব একটা নেই। বিদেশিরাও কম আসছে, এতে করে চাইনিজ ও বিরিয়ানির হোটেলগুলোতেও ক্রেতা কমেছে। আবার গত সরকার বিদেশে সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এতে খোলা এবং প্যাকেটজাত উভয় সুগন্ধি চালের দাম কমেছে।

চালের মোকাম পুলহাটে সুগন্ধি চালের ব্যবসা করেন আব্দুর রশিদ। তিনি বলেন, মিলে সব ধরনের সুগন্ধি চাল রয়েছে। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে না। চাহিদা নেই। এবার তাকে লোকসান গুনতে হবে। আবার এক মাসের মধ্যে চালগুলো বিক্রি করতে না পারলে নতুন চাল চলে আসবে। তখন হয়তো বাজার আরও খারাপ হয়ে যাবে। লোকসান গুনে বাকিতেও বিক্রি হচ্ছে না চাল।

জানা যায়, কয়েক বছরে জেলায় সুগন্ধি ধানের আবাদে বড় পরিবর্তন এসেছে। এসব ধান-চালের ভালো দাম পাওয়া যায়। ফলনও হয় বেশি। এ কারণে দিনাজপুরে সুগন্ধি ধানের আবাদ ১০-১১ বছরের ব্যবধানে ১৫০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।

দিনাজপুরের সদর, বিরল, চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী ও বিরামপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সুগন্ধি ধান-চাল আবাদ ও উৎপাদন হয়।

Advertisement

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে দিনাজপুরে সুগন্ধি ধানের আবাদ বাড়তে শুরু করে। ওই অর্থবছরে জেলায় ৪১ হাজার হেক্টর জমিতে সুগন্ধি ধান আবাদ হয়। উৎপাদন হয় ৮৬ হাজার ৯৯৪ টন সুগন্ধি চাল। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবেই প্রতি বছর সুগন্ধি ধানের জমির পরিমাণ ও উৎপাদন বেড়েই চলেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জেলায় ৯০ হাজার ৪৪০ হেক্টর জমিতে সুগন্ধি ধানের আবাদ হয়। আর সুগন্ধি চালের উৎপাদন ২ লাখ ১৬ হাজার টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জেলায় ১ লাখ ৬ হাজার হেক্টর জমিতে সুগন্ধি ধানের আবাদ হয়েছিল। উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ২৩ হাজার টন। গত বোরো মৌসুমে আবাদ হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি চাল। এবার আমন মৌসুমেও সুগন্ধি ধানের ব্যাপক চাষ হয়েছে। এবার চালের হিসাবে ২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

মিলার ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা যায়, ২০২১ সালের জুলাইয়ে ২৮টি প্রতিষ্ঠানকে ২৫ হাজার টন সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমতি দেয় সরকার। আবার ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি বন্ধও করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে অনুমতি দিলেও সরকার ২০২৩ সালের জুন থেকে আবারো এই সুগন্ধি চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এতে করে ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন লোকসান গুনছে। আর কৃষকরাও চিকন সুগন্ধি ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না।

চালকল মালিক সমিতির সভাপতি মুসাদ্দেক হুসেইন বলেন, অনেক মিলার-চাল ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন। চাল বিক্রি করতে না পারলে ঋণের দায়ে দেউলিয়া হবে মিলগুলো।

ব্যবসায়ীদের এই সংকট কাটাতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে রপ্তানির অনুমতি চান শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন দিনাজপুর চেম্বারের সভাপতি রেজা হুমায়ুন ফারুক চৌধুরী।

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ নুরুজ্জামান জানান, দ্বিগুণ দাম পাওয়ায় কৃষকরা সুগন্ধি ধানের আবাদে ঝুঁকছেন। সারা দেশের সুগন্ধি চালের চাহিদার সিংহভাগ দিনাজপুর জেলা থেকে মেটানো হয়। তবে সরকার দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ রেখেছে।

তিনি বলেন, এবার জিআই স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সুগন্ধি (চিনিগুড়া) চালসহ অন্যান্য সুগন্ধি চাল উৎপাদন হবে ২ লাখ ৫০ হাজার টনের বেশি।

এফএ/এমএস