সংসদের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণকে ইতিহাসের একটি দুর্ঘটনা বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে প্রদান করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদানের সময় এমন মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্ট আদালত।বৃহস্পতিবার বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তরও বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এই সংক্রান্ত রিট মামলায় জারি করা রুলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে রায় ঘোষণা করেন।সংসদের হাতে বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা রাখা কেন উচিত নয়, তার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে রায়ের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন আদালত। যেখানে আদালত বলেন, ‘সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ একটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা।’কমনওয়েলভুক্ত অধিকাংশ দেশেই সংসদের মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা নেই উল্লেখ করে হাইকোর্ট বলেন, কমনওয়েলথভুক্ত ৪২ শতাংশ দেশে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিদ্যমান। অপর ২১ শতাংশ দেশে অভিযোগ স্থায়ী ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। ৬৩ শতাংশ দেশেই হয় এ বিষয়ে স্থায়ী তদন্ত ব্যবস্থা আছে, না হয় জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিদ্যমান। তাই সংসদের মাধ্যমে বিচারক অপসারণ ক্ষমতা কমনওয়েলথভুক্ত অধিকাংশ দেশেই নেই।’যেসব দেশে এই বিধান প্রচলিত আছে সেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থার ভিন্নতা তুলে ধরেন আদালত। আদালত বলেন, যেসব দেশে এই বিধান আছে সেখানেও অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।আদালত বলেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও কানাডার মতো যেসব দেশে সংসদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে সেসব দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আমাদের দেশের সংস্কৃতি একরকম নয়। সেসব দেশের সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়নে স্বাধীন। তাছাড়া ভারত ও শ্রীলঙ্কায় এ ধরনের আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে নানা রকম সমস্যা হচ্ছে। বাংলাদেশে এই আইন কার্যকর হলে একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।পার্লামেন্টের হাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে বলে অভিমত দেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেন না, বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়। আদালত বলেন, আমাদের দেশে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বিদ্যমান। দল যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হলেও বিপক্ষে ভোট দেয়ার সুযোগ নেই। তাই দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তই সংসদে বাস্তবায়িত হয়। এই বিধান কার্যকর হলে বিচাকরদের করুণা প্রার্থী হতে হবে।এই মামলায় আদালত অ্যামিকাস কিউরিদের (আদালতের বন্ধু) মতামত নেন। এক্ষেত্রে ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের দেয়া মতামতের সঙ্গে আদালত সহমত পোষণ করেন। আদালত ৯৫ (২) (সি)তে বিচারক নিয়োগে আইন নেই, সে কথাও স্বরণ করিয়ে দেন। আদালতের রায়ে উঠে আসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথাও।আদালত বলেন, আমরা আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিষয়টি অস্বীকার করতে পারি না। আমাদের দেশ সবসময় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে না। জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে বিভক্তি রয়েছে। তাই সংসদে কোনো দলের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে এই বিধান কার্যকর করা সম্ভবপর হবে না।ড. কামাল হোসেনের অভিমত তুলে ধরে আদালত বলেন, তাই ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির উপর আঘাত আনা হয়েছে। এই সংশোধনী বিচার বিভাগকে দুর্বল করবে। এই বিধানটি রাজনৈতিক অপব্যবহারের সম্ভাবনা আছে বলে অভিমত দিয়েছেন ড. কামাল হোসেন। এটার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করছি।ইতিমধ্যেই এই সংশোধনী নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে আদালত বলেন, ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সম্প্রতি বিলিয়ন বিলিয়ন প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এই সংশোধনীর কারণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে জনগণের মধ্যে সংশয় তৈরি হবে।আদালত বলেন, কমনওয়েলথ দেশগুলোর অভিজ্ঞতা, অন্যান্য দেশের আইন ও আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সব বিষয় বিবেচনায় এই সংশোধনী সংবিধানের মৌল কাঠামো পরিবর্তন করবে। তাই অবৈধ, বাতিল ও বেআইনি ঘোষণা করা হলো।এফএইচ/বিএ
Advertisement