মতামত

পবিত্র কুরআন সার্বজনীন শান্তির ভিত

আল্লাহতায়ালার অপার বৈশিষ্ট্য যে তিনি যুগে যুগে নবি-রাসুল প্রেরণের মাধ্যমে তার সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা ও দয়া প্রদর্শন করে আসছেন।

Advertisement

বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মোহাম্মদ (সা.)এর কাছে পবিত্র কুরআন নাজিল করেছেন যা পরিপূর্ণ ও চূড়ান্ত জীবন বিধান। এতে মানবজাতির জন্য সকল চাহিদা ও জ্ঞানের উপকরণ রয়েছে।

পবিত্র কুরআনই একমাত্র ধর্ম গ্রন্থ যার ব্যাপারে আল্লাহপাকের প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে এতে কোনোরকম বিকৃতি ঘটবে না। আজ পর্যন্ত আল্লাহপাক শব্দ ও অর্থের দিক দিয়ে সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে আসছেন।

পবিত্র কুরআনের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হল, এতে সকল দেশ, জাতি, বর্ণ ও ধর্মের মানুষের জন্য বার্তা রয়েছে। কুরআন সকল ধর্মের নবিকেই সত্য নবি এবং তাদের ধর্মগ্রন্থকে তাদের সময়ের জন্য সঠিক বলে ঘোষণা দেয়। মহানবির (সা.) আগমনের সময় আরব জাতি চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। বাকি বিশ্বও এই অন্ধকার থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। এই চরম বিশৃঙ্খল ও অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে আরবের মাটিতে নতুন সূর্যের উদয় হয়। পবিত্র কুরআন অন্ধকারাচ্ছন্ন আরব জাতিকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে ফেলে এবং তারা পরবর্তীতে বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়। পবিত্র কুরআন স্বল্প সময়ে আরব জাতির মধ্যে এক আধ্যাত্মিক বিপ্লব সাধন করে। এতে তারা এক আল্লাহর ইবাদতকারীতে পরিণত হয়। কুরআনে সুরা আল ফুরকানে তাদের সম্বন্ধে বলেছে “রহমানের প্রকৃত বান্দা তারা, যারা তাদের প্রভুর সমীপে সেজদাবনত ও দণ্ডায়মান অবস্থায় রাত্রি অতিবাহিত করে”।

Advertisement

হজরত উমর (রা.) ইসলামের একজন মহান খলিফা হয়েছিলেন এবং তার সময়ের একজন মহান শাসক ছিলেন। তিনি বর্ণনা করেছেন, কীভাবে পবিত্র কুরআনের বাণী শোনার মাধ্যমে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এটি কুরআনের এক বিপ্লব ছিল। যে উমর (রা.) পূর্বে ইসলামের চরম শত্রু ছিল তাকেও কুরআন সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে ফেলে। তিনি আনুগত্যে এতটাই অগ্রসর হয়ে যান যে পরবর্তীতে ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হন।

একইভাবে ইসলামের তৃতীয় খলীফা হজরত উসমান (রা.) যিনি ইসলামের মহান শাসক ছিলেন এবং যার সময়ে ইসলামিক সাম্রাজ্য মদিনা থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল, তিনিও পবিত্র কুরআনের আয়াত শুনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

মহানবির (সা.) সাহাবী হজরত ইবনে আব্বাস (সা.) বলেন, যখন হজরত জাফর ইথিওপিয়া থেকে ফিরে আসছিলেন তখন তার সাথে কয়েকজন খ্রিষ্টান নাবিক ছিল। মহানবির (সা.) কুরআন তেলাওয়াত শুনে তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে এবং তারা সে মুহূর্তেই ইসলাম গ্রহণ করে। মহানবি (সা.) জানতে চান যে ইথিওপিয়াতে গিয়ে তারা কি আবার তাদের পূর্বের ধর্মে ফিরে যাবে কিনা। তারা বলেন, তারা কখনো ইসলামকে পরিত্যাগ করবে না।

এরকম অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে পবিত্র কুরআন সকল প্রকারের অন্ধকারকে আধ্যাত্মিক আলোতে রূপান্তর করেছে।

Advertisement

এছাড়া পবিত্র কুরআন মানবাধিকারকেও এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে যেটি পূর্বে কোন ধর্মগ্রন্থ করেনি। এটিই প্রথম এবং একমাত্র ঐশী কিতাব যা কেবল নারীদের পক্ষে কথাই বলেনি বরং নারীদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনের সুরা নিসায় বলেছেন “এবং যে কেউ সৎ কাজ করে, সে পুরুষ হোক বা নারী এবং সে মোমেন, এই প্রকারের ব্যক্তিগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি বিন্দুমাত্রও অন্যায় করা হবে না”।ইসলামের পূর্বে কিছু আরব গোত্রে সম্মানের নামে মেয়ে সন্তানদের জীবন্ত কবর দেয়া হত। ইসলাম চিরতরে এই প্রথাকে বিলুপ্ত করে এবং মহানবি (সা.) ঘোষণা দেন যেব্যক্তি তাদের কন্যাদের বড় করবে এবং শিক্ষা প্রদান করাবে, পবিত্র কুরআন ঘোষণা দিচ্ছে যে তাদেরকে জান্নাতে স্থান দেয়া হবে।

ইসলামের পূর্বে নারীদের সম্পদের মালিকানা ছিল না কারণ তাদেরকেই পুরুষদের সম্পত্তি মনে করা হত। এমনি বিধবাদেরও মৃত স্বামীর সম্পত্তি হিসেবে বণ্টন করা হত এবং তাদের নিজেদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে তাদের কোন মতামত দেবারই অধিকার ছিল না।

ইসলাম নারীদের উত্তরাধিকারের অধিকার প্রদান করে, যার ফলে তারা নিজেদের ঘরের রানি হয়ে থাকে। মহানবি (সা.) স্ত্রীদের সম্মান প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বলেন “তোমাদের মধ্যে সেই সবচেয়ে উত্তম যে তার স্ত্রীদের সাথে ভাল ব্যবহার করে এবং আমি তোমাদের মধ্যে স্ত্রীদের সাথে ভাল ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম।” পবিত্র কুরআন আমাদের শিক্ষা দেয় আমরা যেন সকল ধর্মের মানুষ ও তাদের নবি, ধর্মযাজক ও সন্ন্যাসীদের সম্মান করি এবং পারস্পরিক সহনশীলতার পরিবেশ গড়ে তুলি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেন “ধর্মের ব্যাপারে কোন বল প্রয়োগ নেই” (২: ২৫৮)।

মদিনা সনদে ইসলামের এই শিক্ষাই দেখা যায়। যার মাধ্যমে সকল মানুষের অধিকার, ধর্মীয় ও ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা হয়। এই সনদ সকল ধর্মের মানুষকে তাদের অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করে যার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ ও একতাবদ্ধ দেশ গড়ে উঠে। একইভাবে নাজরানের খ্রিষ্টানদের সাথে যে চুক্তি হয় তাতেও একই শিক্ষার অনুসরণ করা হয়। সেখানে বলা হয় সকল ধর্মযাজক, ইবাদতের স্থান ও সেখানে বসবাসরত মানুষকে আল্লাহ ও তার নবি (সা.) পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করবেন। কোনো ধর্মযাজককে তার ইবাদতের স্থান থেকে সরানো হবে না। মহানবি (সা.) এরকম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে কোন বিশেষ দল তার কাছে কোন বিশেষ অনুগ্রহ পেত না, কারণ আল্লাহপাক এরকম পক্ষপাতিত্বহীন আচরণেরই নির্দেশ দিয়েছিলেন।

একবার একজন মহিলা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ল যিনি অনেক সম্ভ্রান্ত বংশের ছিলেন। এতে আরব গোত্রের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে কারণ তার মতো একজন সম্ভ্রান্ত মহিলাকে শাস্তি দিলে তার গোত্রের সম্মানহানি হবে। মহানবির (সা.) একজন প্রিয় সাহাবি ওসামা বিন যায়েদকে মহানবির (সা.) কাছে পাঠানো হয় যেন তিনি অনুরোধ করেন মহানবি (সা.) যেন সেই মহিলাকে ক্ষমা করে দেন।

মহানবি (সা.) তাকে বলেন ‘হে ওসামা, মন দিয়ে শোন! আমাদের পূর্বের অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে কারণ তারা সমাজের সম্ভ্রান্ত শ্রেণিদের বিশেষ সুবিধা দিত এবং নীচু শ্রেণিদের সাথে অবিচার করত। ইসলাম এরকম পক্ষপাতিত্বের অনুমতি দেয় না এবং আমি কখনো এরকম করতে পারব না। আল্লাহর কসম! আমার মেয়ে ফাতিমাও যদি এই অপরাধ করত, আমি তাকেও শাস্তি প্রদান করতাম’ (সহিহ মুসলিম)।

ইসলাম সমাজের সকলকেই একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বলে সার্বজনীন শান্তির ভিত প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমান বিশ্বে অশান্তি, অরাজকতা, আর্থিক ও বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে যা এক বিশ্বযুদ্ধের দিকে আমাদের ঠেলে দিচ্ছে। এর মূল কারণ হল, আমরা শান্তি, ন্যায়বিচার ও মৌলিক মানবাধিকারকে ভুলে গিয়েছি। আমরা যদি বিশ্বে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাই তাহলে পবিত্র কুরআনের সার্বজনীন আধ্যাত্মিক শিক্ষার অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহপাক সকলকে সেই তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামী চিন্তাবিদ।masumon83@yahoo.com

এইচআর/জিকেএস