• চার মিনিটের মধ্যে তিন দফায় ঘটে বিস্ফোরণ• মেনটেন্যান্স কাজের জন্য স্টোরে প্রবেশের মুহূর্তেই ঘটে বিস্ফোরণ
Advertisement
স্টোরে থিনারের জমাট বাঁধা গ্যাসে ইলেক্ট্রিক স্পার্ক হওয়ায় বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জাহাজ বাংলার জ্যোতিতে বিস্ফোরণ হতে পারে। কালো ধোঁয়া বের হওয়ার পর চার মিনিটের ব্যবধানে পরপর তিনবার বিস্ফোরণ ঘটে জাহাজটিতে। এতে মারা যান তিনজন।
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) গঠিত অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে প্রতিবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে জাগো নিউজ। সাত সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি বুধবার (২ অক্টোবর) সন্ধ্যায় হাতে পান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শরীফ হাসনাত।
সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টায় পতেঙ্গা ইস্টার্ন রিফাইনারির ৭ নম্বর ডলফিন জেটিতে বিএসসির মালিকানাধীন বাংলার জ্যোতি ট্যাংকার জাহাজে বিস্ফোরণে জাহাজের ডেক ক্যাডেট সৌরভ কুমার সাহা, বিএসসির ফোরম্যান নুরুল ইসলাম ও শ্রমিক মো. হারুন নিহত হন।
Advertisement
এ ঘটনা তদন্তে তিনটি আলাদা কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএ) এবং বিএসসি।
সূত্র জানায়, এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজে অগ্নিদুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে সাত সদস্যের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করে ইস্টার্ন রিফাইনারি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. শরীফ হাসনাত স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে গঠিত কমিটিকে ১ অক্টোবরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
কমিটিতে ইআরএলের ডিজিএম (আইঅ্যান্ডএস) প্রকৌশলী এ কে এম নঈম উল্লাহকে আহ্বায়ক এবং ম্যানেজার (সেফটি) প্রকৌশলী বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকীকে সদস্য সচিব করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ডিজিএম (পিঅ্যান্ডএস) প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজার রহমান, ডিজিএম (ইন্সটলেশন) প্রকৌশলী মো. নাজির আহমেদ, এজিএম (জি অ্যান্ড ই) প্রকৌশলী মুহাম্মদ শরাফত আলী, এজিএম (শিপিং) মো. শাহীনুর তালুকদার এবং এজিএম (ট্রেনিং/এফ অ্যান্ড এস) মো. রফিকুল ইসলাম।
কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান করা মাদার ভ্যাসেল ‘ওমেরা লিগ্যাসি’ থেকে ক্রুড অয়েল নিয়ে ইআরএলের ডলফিন জেটি-৭ এ সোমবার সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে মুরিং শুরু করে এমটি বাংলার জ্যোতি। জাহাজটিতে ৪৩ জন ক্রু ছিলেন। সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে ইআরএলের তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ার মেসার্স ওশানটেক লিমিটেড জাহাজটি সার্ভে করে। সার্ভে অনুযায়ী জাহাজটিতে ১১ হাজার ৭১৬ দশমিক ৪৪৬ মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল ছিল। সকাল ১০টায় ক্রুড খালাস শুরু হয়।
Advertisement
ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে তদন্ত কমিটি জানতে পারে, সকাল ১০টা ৫৩ মিনিটে দুজন ক্রু জাহাজের সম্মুখভাগের ফোর পিক স্টোরের ওপরের অংশে প্রবেশ করে। পরবর্তীসময়ে ১০টা ৫৩ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে আরও একজন ওই স্থানে পৌঁছায়। তদন্ত কমিটির ধারণা ওই তিনজনই ফোর পিক স্টোরে প্রবেশ করেন। ১০টা ৫৪ মিনিট ১৫ সেকেন্ডে জাহাজের ওই স্টোরের ওপর কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলি বের হতে থাকে এবং ৭ সেকেন্ড পর স্টোরের ওই অংশে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের তীব্রতায় স্টোর কম্পার্টমেন্ট থেকে বিভিন্ন অংশ আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এসময় কালো ধোঁয়াসহ আগুন জ্বলতে দেখা যায়। ১০টা ৫৪ মিনিট ২৭ সেকেন্ডে দ্বিতীয়বার বিস্ফোরণ হয়। ১০টা ৫৯ মিনিটের দিকে তৃতীয় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে আগুনের তীব্রতা বাড়ে।
মেনটেন্যান্স কাজের জন্য স্টোরে প্রবেশের মুহূর্তেই ঘটে বিস্ফোরণ ইআরএলের তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনাকবলিত বাংলার জ্যোতির চিফ অফিসারসহ ছয়জনের বক্তব্য নেন। জাহাজের চিফ অফিসার মো. সাইদুজ্জামান তদন্ত কমিটিকে বলেন, ‘জাহাজের হাইড্রোলিক কুলারসহ কিছু মেনটেন্যান্স কাজের ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া ছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিএসসি মেরিন ওয়ার্কশপ থেকে মেনটেন্যান্সের লোকজন জাহাজে এসেছিল। মেনটেন্যান্স কাজের জন্য স্টোররুমে প্রবেশের মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটে।’
জাহাজের পাম্পম্যান মো. সেলিম তদন্ত কমিটিকে বলেন, ‘ফোর পিক স্টোরে রশি, নোঙর, স্পেয়ার পার্টস, পেইন্ট, থিনার ইত্যাদি রাখা হয়। মেনটেন্যান্স কাজ করার জন্য তিনজন স্টোররুমে প্রবেশ করার মুহূর্তে বিস্ফোরণ হয়।’
কমিটির পর্যবেক্ষণবিস্ফোরণের আগে সোমবার সকাল ১০টা থেকে ১০টা ২০মিনিট পর্যন্ত বিএসসি মেরিন ওয়ার্কশপের কয়েকজন কর্মী রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য জাহাজটিতে ওঠেন। জাহাজটির ফোর পিক স্টোর একটি আবদ্ধ জায়গা। ওই স্টোরে রাখা থিনার থেকে নির্গত পরিবর্তনশীল বাষ্পের কারণে প্রচুর দাহ্য গ্যাস জমা হয়ে বিস্ফোরক মিশ্রণ তৈরি হতে পারে, যা হিট সোর্সের (মেকানিক্যাল বা ইলেক্ট্রিক স্পার্ক) উপস্থিতিতে বিস্ফোরিত হয়েছে বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। বিস্ফোরণের ফলে জাহাজের সম্মুখভাগ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তদন্ত কমিটি কারিগরি দিক পর্যালোচনা করে ‘ফায়ার ট্রায়াঙ্গেল থিওরি’ অনুসারে আগুন লাগার জন্য তিনটি উপাদান (ফুয়েল, অক্সিজেন এবং ইননিশন সোর্স) অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেন। স্টোরে থাকা থিনার থেকে নির্গত বাষ্প উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক। থিনার কনটেইনার যথাযথ সিলড না থাকলে থিনার থেকে পরিবর্তনশীল গ্যাস বাষ্পীভূত হয়ে উচ্চ দাহ্য পদার্থে রূপ নেয়। বিস্ফোরণের পূর্ব মুহূর্তের ধোঁয়া এবং বিস্ফোরণ পরবর্তী অগ্নিকাণ্ডের ধরন বিবেচনায় শর্টসার্কিট কিংবা ইলেক্ট্রিক্যাল স্পার্কের সঙ্গে দাহ্য গ্যাসের সংস্পর্শে বিস্ফোরণ ঘটে থাকতে পারে বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়।
কমিটির ১৪ সুপারিশ১. বিপিসির অধীন কোম্পানির জেটিগুলোর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এবং আধুনিকায়নের পাশাপাশি জেটিগুলোর মধ্যে ফায়ার ওয়াটার নেটওয়ার্কের মধ্যে ইন্টার-কানেক্টিভিটি থাকা প্রয়োজন।
২. এ ধরনের তেলবাহী জাহাজে গ্যাস ডিটেকশন সিস্টেম থাকা প্রয়োজন। এছাড়া পাম্পরুম, স্টোররুম বা অন্য কোনো আবদ্ধ কক্ষে প্রবেশের আগে যথাযথ ভেন্টিলেশন নিশ্চিত করে প্রবেশ করা প্রয়োজন।
৩. তেলবাহী জাহাজের আবদ্ধ কক্ষে প্রবেশের আগে রুমটির প্রপার ভেন্টিলেশন নিশ্চিত করার পাশাপাশি পোর্টেবল গ্যাস ডিটেক্টরের মাধ্যমে কম্বাস্টিবল/ফ্ল্যামাবল গ্যাস, অক্সিজেন লেভেল ইত্যাদি চেক করে নেওয়া প্রয়োজন।
৪. বার্থিংরত অবস্থায় বা লোডিং/আনলোডিং চলাকালীন যে কোনো রক্ষণাবেক্ষণ কাজের আগে কাজের ধরন অনুযায়ী যথাযথ কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নেওয়া প্রয়োজন।
৫. ডলফিন জেটি-৭ এ আরও অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ফায়ার মনিটর স্থাপন, মনিটরের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিদ্যমান ফায়ার ওয়াটার নেটওয়ার্ক জেটির উভয়প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত করা যেতে পারে।
৬. ডলফিন জেটি-৭ এ ফায়ার ইমার্জেন্সি মোকাবিলায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ডিজেল ইঞ্জিনচালিত ফায়ার পাম্প স্থাপনের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
৭. পতেঙ্গাস্থ সব অয়েল ইন্সটলেশন জরুরি পরিস্থিতিতে ফায়ার ফাইটিংয়ের জন্য এই জোনে বিশেষায়িত ফায়ার স্টেশন স্থাপন করা যেতে পারে।
৮. ডলফিন জেটি-৭ এ কর্মরত স্থায়ী/অস্থায়ী সব কর্মকর্তা/কর্মচারীর বেসিক ফায়ার ফাইটিং ট্রেনিং বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
৯. তেলবাহী সব ট্যাংকারের ফায়ার সেফটি ব্যবস্থার কোড কমপ্লায়েন্সের জন্য নিয়মিত থার্ড পার্টি সেফটি অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে।
১০. তেলবাহী ট্যাংকারের ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা দুর্ঘটনার সময় কর্মক্ষম রাখার জন্য বিকল্প পাওয়ার সোর্সের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
১১. পোর্ট ফ্যাসিলিটির আওতায় স্থাপিত জেটিগুলো ইমার্জেন্সি মোকাবিলায় বন্দর কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে ইউজার ও লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যকরী সমন্বয় কমিটি বা নিয়ন্ত্রণ কমিটি থাকা প্রয়োজন।
১২. জেটি ও জাহাজ উভয়ক্ষেত্রে ইমার্জেন্সি মোকাবিলায় স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) রাখতে হবে।
১৩. জাহাজ ও জেটিতে ফ্ল্যামাবল এবং কম্বাস্টিবল বস্তু মেটেরিয়াল সেফটি ডাটা শিট (এমএসডিএস) অনুযায়ী যথাযথ স্থানে নিয়ম মেনে স্টোর করতে হবে।
১৪. এ ধরনের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে আরও জেটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করা প্রয়োজন।
এমডিআইএইচ/এএসএ/জিকেএস