পাবনার ঈশ্বরদীতে পরপর ৩ দফা অতিবৃষ্টির ফলে আগাম শিমের ফলন বিপর্যয় হয়েছে। উপজেলার ৯১০ হেক্টর জমির অধিকাংশ পানিতে ডুবে যাওয়ায় পোকার আক্রমণে গোড়া পচে যাচ্ছে। পাতা শুকিয়ে হলুদ হয়ে গেছে। ঝরে গেছে ফুল। ফলে মারাত্মক ফলন বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। গত বছর এ মৌসুমে প্রতিদিন ১ বিঘা জমিতে ৪০-৫০ কেজি শিম সংগ্রহ করা যেত। এবার ১ বিঘা জমি থেকে ১ কেজি শিমও মিলছে না।
Advertisement
উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নের বাঘহাছলা, শেখপাড়া, মুলাডুলি মধ্যপাড়া ও গোয়ালবাথান এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শত শত হেক্টর জমিতে আগাম শিমের আবাদ হয়েছে। যেদিকে চোখ যায় সেখানেই দেখা যাচ্ছে শুধু শিমের আবাদ। চাষিরা শিম গাছ পরিচর্যা, সার-বীজ প্রয়োগ ও শিম সংগ্রহ করছেন। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমানতালে শিমের ফুল ও ডগা পরিচর্যার কাজ করছেন।
শিম চাষিরা জানান, উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নে প্রায় ২০ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে শিম চাষ হয়। শিম শীতকালীন সবজি হলেও বেশি লাভের আশায় ৮ বছর ধরে আগাম জাতের রূপবান ও অটোজাতের শিম চাষ শুরু করেন। শীত মৌসুমের আগেই এ শিম বাজারে ওঠায় মূল্য বেশি পান। ফলে আগাম শিম চাষের প্রতি সবাই আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে আগাম শিমের চাষ বাড়তে থাকে। এতে লাভবান হয়ে কৃষক তাদের ভাগ্য বদল করেছেন। আগাম শিম চাষে নানা প্রতিকূলতা আছে। এতে সার, কীটনাশক ও সেচের পরিমাণ বেশি লাগে। খরচও বেশি হয়। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই।
চাষিরা আরও জানান, এ বছর আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে পরপর তিনবার নিম্নচাপের প্রভাবে প্রবল বৃষ্টি হয়। এতে আগাম শিমের বেশিরভাগ জমি পানিতে ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া শিম ক্ষেত নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। গোড়ায় পচন ধরেছে, পাতা হলদে হয়ে যাচ্ছে। শিমের ফুল ঝরে গেছে। কীটনাশক ও সার ব্যবহার করেও পচন ঠেকানো যাচ্ছে না। এ বছর আগাম শিমের জমিতে ফলন শুরু হয়েছিল। প্রতি বিঘায় ১৫-২০ কেজি পর্যন্ত শিম সংগ্রহ করা যেত। এখন ১ বিঘা জমিতে ১ কেজি শিমও পাওয়া যাচ্ছে না। শিমের কেজি এখন ৩০০ টাকা হলেও গাছ নষ্ট হওয়ায় বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। শিমের জমির যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তাতে কৃষকদের ব্যাপক লোকসান গুনতে হবে।
Advertisement
শেখপাড়া গ্রামের শিম চাষি রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘আগাম শিম চাষিদের বুকে এবার বোবা কান্না। আমার ৫ বিঘার শিমের জমি এখন পুরোটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম। পোকার আক্রমণে গাছ মরে যাচ্ছে। যে জমি থেকে ২০ দিন আগেও ৪০-৪৫ কেজি শিম বিক্রি করেছি। সেই জমিতে এখন কোনো শিম নেই। ৫ বিঘা জমিতে শিম আবাদ করতে এরই মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে পুরো শিম গাছের ফুল ঝরে গেছে, গাছে পচন ধরেছে। আমার মতো শত শত কৃষক এবার নিস্ব হয়েছে।’
আরও পড়ুন
সারাবছরই চাষ করুন উচ্ছে বা করলা নীলফামারীতে ৩ লক্ষাধিক বস্তায় আদা চাষমুলাডুলির শিম চাষি রাজিব হোসেন বলেন, ‘পরপর ৩ দফা বর্ষণের ফলে আগাম শিমের জমি পানিতে ডুবে গিয়েছিল। এখন পানি কমলেও গাছের গোড়ায় পোকার আক্রমণে গাছ মরে যাচ্ছে। পাতা হলদে হয়ে ঝরে যাছে। শিমের ফুল ও ডগা যা বের হয়েছিল, তা নষ্ট হয়ে গেছে। আগাম শিমের যারা চাষ করেছিলেন; তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকেই আবার নষ্ট হয়ে যাওয়া আগাম শিমের জমির গাছ উপড়ে ফেলে দিয়ে পরিষ্কার করে শীতকালীন শিম চাষের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।’
বাঘহাছলা গ্রামের শিম চাষি এনামুল ইসলাম এলিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘হঠাৎ পরপর তিনবার প্রবল বর্ষণে জমিতে পানি জমে যাওয়ায় শিম গাছ এখন মরে যাচ্ছে। এই এলাকার পাশ দিয়ে নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্ষার পানি রেললাইনের কারণে নিষ্কাশন হতে পারে না। ফলে বৃষ্টিতে পুরো এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। জলাবদ্ধতার কারণে শিম গাছের গোড়ায় পচন ধরেছে। সার ও কীটনাশক দিয়েও পচন রোধ করা যাচ্ছে না।
Advertisement
একই গ্রামের বানেছা বেগম বলেন, ‘বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার কারণে শিম গাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ১৫ দিন আগে জমি থেকে শিম তুলেছি। এখন জমিতে কোনো শিম নেই। শিমের গাছ মরে যাচ্ছে, ফুল ঝরে যাচ্ছে। শিম চাষিদের সবাই ক্ষতিগ্রস্ত।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়ন শিম চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। উপজেলায় ১৪০০ হেক্টর জমিতে শিমের আবাদ হয়। আগাম শিমের আবাদ হয়েছে ৯১০ হেক্টর। কয়েক দফা প্রবল বর্ষণে জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে শিমের গাছগুলো প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলে।’
কৃষকদের প্রতি পরামর্শ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যেসব জমিতে এখনো জলাবদ্ধতা আছে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করুন। যেসব কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কৃষি বিভাগ চেষ্টা করছে আগামী রবি প্রণোদনায় তাদের সহযোগিতা করে ক্ষতিটা কিছুটা হলেও পুষিয়ে দেওয়ার। এ ছাড়া শিমের গাছ রক্ষায় মাঠপর্যায়ে কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তারা নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।’
শেখ মহসীন/এসইউ/এমএস