জাতীয়

আরামদায়ক গণপরিবহন থেকে বঞ্চিত দেশবাসী

রাজধানীর সড়কে তুমুল সাড়া ফেলেছিল আরামদায়ক ও দৃষ্টিনন্দন ভলভো বাস। ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে কেনা ৫০টি ভলভো বাস পাল্টে দিয়েছিল ঢাকার গণপরিবহনের চিত্র। এক কোটি তিন লাখ টাকার সুইডিশ বাসগুলোর আয়ুষ্কাল ছিল ১৫ বছর। তবে আট বছরেই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে।

Advertisement

আওয়ামী লীগ সরকার বাসগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে ব্যর্থ হয়। এক পর্যায়ে বিক্রি করা হয় ভাঙারি হিসেবে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে নতুন করে দুটি প্রকল্প নেওয়া হয় আরামদায়ক গণপরিবহন কেনার জন্য। কিন্তু ভলভো বাসের বাজে অভিজ্ঞতার প্রভাবে সহসাই কেনা হচ্ছে না ডিজেল ও বিদ্যুৎচালিত এসি বাসগুলো।

একটি প্রকল্পের আওতায় দুই হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা খরচ করে বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রিক বাস কেনার কথা। অন্তর্বর্তী সরকারে পরিকল্পনা উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এটিসহ দুটি প্রকল্প বাদ দিচ্ছেন বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র।

আমলাতন্ত্র পরিবহন ব্যবস্থাকে নষ্ট করে ফেলবে। নন-টেকনিক্যাল লোক দিয়ে এটা হবে না। প্রকিউরমেন্ট বিলাসী বিষয়, এখানে নয়-ছয় হয়। প্রকিউরমেন্ট করলেই টাকা-পয়সা নয়-ছয় করা যায়।- পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক

Advertisement

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এর আগে একাধিক প্রকল্প বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনকে (বিআরটিসি) দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিআরটিসি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেনি। এছাড়া দুটি প্রকল্পের আওতায় গণপরিবহন কিনলে কতটা লাভ কতটা দেশের আর্থিক ক্ষতি সেটাও দেখা হবে? প্রকল্পের আওতায় একটি ভারতীয় ঋণ আছে। এসব কারণেই সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে প্রকল্প দুটি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে ফেরত পাঠিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

পরিকল্পনা কমিশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্প দুটি ফেরত পাঠানো হয়েছে। বিআরটিসি প্রকল্প নেয় শুধু প্রকিউরমেন্টের জন্য, জনগণের সেবার জন্য নয়। তাছাড়া দুটি প্রকল্পে আর্থিক কতটা লাভ-ক্ষতি হবে তার কোনো হিসাব নেই। সুতরাং, বিষয়গুলো বিস্তারিত রিভিউ না করে প্রকল্প নেওয়া ঠিক হবে না। বর্তমান সরকারও এ ধরনের প্রকল্পে আরও যাচাই-বাছাই করতে বলেছে। বৈদেশিক ফান্ডেরও একটা ব্যাপার আছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিসির পরিচালক (কারিগরি) কর্নেল মোহাম্মদ মোবারক হোসেন মজুমদার, পিএসসি জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নের জন্য বৈদেশিক ফান্ড খোঁজা হচ্ছে। তবে এখনো পাওয়া যায়নি।’

বাতিল হচ্ছে ৩৪০ কোরিয়ান বৈদ্যুতিক এসি বাস কেনার উদ্যোগ

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি ছিল ‘বিআরটিসির জন্য বৈদ্যুতিক একতলা এসি বাস সংগ্রহ’ প্রকল্প। বিআরটিসি প্রস্তাবিত প্রকল্পটি একনেক সভায় উপস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়নি।

Advertisement

আরও পড়ুন ৫০ কোটি টাকার নৈপুণ্য অ্যাপের ভবিষ্যৎ কী? সাড়ে ২৯ কোটি টাকার সমীক্ষা, ৯৭ শতাংশই যাবে পরামর্শকের পকেটে! ঢাকার লক্কড়-ঝক্কড় বাস বদলে নতুন বাস নামানোর দাবি ঢাকার গণপরিবহনে ‘ওয়েবিল’র নামে নৈরাজ্য

প্রথমে সিএনজিচালিত বাসের প্রস্তাবনা পাঠানো হলেও পরে বৈদ্যুতিকভাবে পরিচালনার ছক কষা হয়। বিআরটি রুট ও মেট্রোরেলের যাত্রীদের স্টেশন থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিতে ৩৪০টি বৈদ্যুতিক কোরিয়ান এসি বাস কেনার উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। প্রস্তাবিত প্রকল্পের মোট প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ১৩৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৩০৪ কোটি ৮৩ লাখ এবং কোরিয়ান ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড ৮২৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ৪০টি সিএনজিচালিত সিঙ্গেল ডেকার এসি সিটি বাস, ১৫ শতাংশ খুচরা যন্ত্রাংশ ও সম্পর্কিত পরিষেবা সংগ্রহে ৩৭২ কোটি ৬০ লাখ টাকা ও ২০০টি সিএনজিচালিত সিঙ্গেল ডেকার এসি ইন্টারসিটি বাস ও ১৫ শতাংশ খুচরা যন্ত্রাংশ খাতে ব্যয় ধরা হয় ৬৫৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় ধরা হয় ১১ কোটি ৮১ লাখ এবং পরামর্শক খাতে ৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা।

১০০ এসি বাস কেনার উদ্যোগও বাতিল

দেশে প্রথমবারের মতো ১০০ বৈদ্যুতিক দ্বিতল এসি বাস কেনার উদ্যোগ নেয় বিআরটিসি। বাসগুলো কিনতে ব্যয় হওয়ার কথা এক হাজার ২৫২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। সরকারি ব্যয় ২৫৬ কোটি ২৭ লাখ এবং ভারতীয় ঋণ ধরা হয় ৯৯৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরতলিতে বাসগুলো চলাচল করার পরিকল্পনা ছিল।

চলতি সময় থেকে ৩০ জুন ২০২৫ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা। ‘বিআরটিসির জন্য বৈদ্যুতিক দ্বিতল এসি বাস সংগ্রহ’ প্রকল্পের আওতায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। আন্তঃনগরের নির্ভরযোগ্য এবং আরামদায়ক গণপরিবহন সুবিধা বাড়ানো, আধুনিক প্রযুক্তিগত পরিবহন ব্যবস্থায় প্রবেশ করা, বিআরটিসি বহর থেকে পুরোনো বাস প্রতিস্থাপন, শহরে যানজট এবং পরিবেশ দূষণ কমানো ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।

এর আগে বিএনপি জোট সরকারের আমলে ২০০২ সালে সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (সিডা) অর্থায়নে ৫০টি ভলভো বাস আমদানি করা হয়। বাসগুলোর একেকটির মূল্য এক কোটি তিন লাখ টাকা। দৃষ্টিনন্দন বাসগুলো প্রথম সাত-আট বছর সড়কে দাপটের সঙ্গে চলাচল করে। ধীরে ধীরে সেগুলোর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট হতে শুরু করে। এসব যন্ত্রাংশ মেরামতে দফায় দফায় প্রকল্প হাতে নেয় বিআরটিসি। কিন্তু যন্ত্রাংশগুলো দেশে দুষ্প্রাপ্য ও ব্যয়বহুল হওয়ায় তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সংস্থাটি।

ফলে অকেজো বিলাসবহুল বাসগুলো দীর্ঘদিন পড়ে থাকার পর ৪৯টি বিক্রি করে বিআরটিসি। রাজধানীর বিভিন্ন ডিপোতে পড়ে থাকা এসব বাস ভাঙারি হিসেবে কেজি দরে বিক্রি করা হয়। সচল আছে কেবল একটি। সেটি রাজধানীর মিরপুর ডিপোর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। বাসটি এখন সুপ্রিম কোর্টের স্টাফদের আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়।

নতুন আধুনিক বাসের অবস্থাও যেন ভলভো বাসের মতো না হয় সেই শঙ্কা প্রকাশ করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। এ শঙ্কার কারণেই বাসগুলো কেনার উদ্যোগ বাতিল হয়েছে।

দুটি প্রকল্প বিআরটিসিকে দেওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিআরটিসিকে আগে প্রফেশনাল করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে আমলা থাকলে তারা নিজেই লাভবান হবে। পরিবহন কিন্তু এক ধরনের বিজ্ঞান। সুতরাং, পরিবহন সেক্টরে টেকনিক্যাল লোক দরকার। আমলা দিয়ে পরিবহনের উন্নয়ন হবে না, তারা প্রকিউরমেন্ট পছন্দ করে। প্রকিউরমেন্ট কেন পছন্দ আমরা সবাই জানি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমলাতন্ত্র পরিবহন ব্যবস্থাকে নষ্ট করে ফেলবে। নন-টেকনিক্যাল লোক দিয়ে এটা হবে না। প্রকিউরমেন্ট বিলাসী বিষয়, এখানে নয়-ছয় হয়। প্রকিউরমেন্ট করলেই টাকা-পয়সা নয়-ছয় করা যায়।’ বিআরটিসি সংস্কার না করে কোনো কেনাকাটা করতে দেওয়া উচিত নয় মন্তব্য করে এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘রিফর্ম না করে জনগণের টাকা বিআরটিসিকে দেওয়া উচিত নয়। এখানে বিজ্ঞান ও টেকনিক্যাল লোক বসাতে হবে। আগের বাসগুলো কেন অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল পার করলো না এর জবাবদিহিতা করতে হবে। এর আগে সুইডেনের ভলভো বাসগুলো কীভাবে লুটপাট হয়েছে আমরা দেখেছি।’

এমওএস/এএসএ/এএসএম