স্বাস্থ্য

অক্টোবরে আরও ভয়ংকর রূপ নিতে পারে ডেঙ্গু

• ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুরোগীর চাপ• উড়ন্ত মশা নিধনে উদ্যোগ নেই • ডেঙ্গুর হটস্পট নির্ধারণ করে ব্যবস্থা নিতে হবে• সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে ৮০ মৃত্যু, আক্রান্ত ১৮০৯৭• ৯ মাসে মৃত্যু ১৬৩, মোট আক্রান্ত ৩০৯৩৮

Advertisement

দেশে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর সারি। সদ্য সমাপ্ত সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুর চোখ রাঙানি দেখেছে দেশ। যেখানে আগের মাস আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল তিনগুণ। আগের আট মাসের সমান মৃত্যু ছিল এক মাসেই। তবে অক্টোবরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ সেপ্টেম্বরের অবস্থাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। অক্টোবরে ডেঙ্গু আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের ৯ মাসের মধ্যে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে সেপ্টেম্বরে। সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে ৮০ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, যা ৯ মাসের মোট মৃত্যুর প্রায় ৫০ শতাংশ। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মোট মারা গেছেন ১৬৩ জন।

ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ায় এরই মধ্যে ঢাকার প্রধান সরকারি হাসপাতালগুলোতে দেখা দিয়েছে শয্যা সংকট। হাসপাতালের মেঝেতে থেকেও চিকিৎসা নিতে হচ্ছে রোগীদের

Advertisement

অন্যদিকে, গত ৯ মাসে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৩০ হাজার ৯৩৮ জন। যেখানে ১৮ হাজার ৯৭ জনই আক্রান্ত হয়েছে সেপ্টেম্বরে, যা মোট আক্রান্তের প্রায় ৬০ শতাংশ।

ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুরোগীর চাপ

ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ায় এরই মধ্যে ঢাকার প্রধান সরকারি হাসপাতালগুলোতে দেখা দিয়েছে শয্যা সংকট। হাসপাতালের মেঝেতে থেকেও চিকিৎসা নিতে হচ্ছে রোগীদের।

সরেজমিনে মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের চতুর্থ তলায় পুরুষ ডেঙ্গু ওয়ার্ড করা হয়েছে। সেখানকার সবগুলো বেড ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীতে পরিপূর্ণ। মেঝে ও করিডোরেও রোগীদের অতিরিক্ত চাপ। চলাচলের জায়গার অভাবে চতুর্থ তলায় রোগী ও স্বজনদের জটলা তৈরি হচ্ছে।

আরও পড়ুন ডেঙ্গুরোগী বেশি দক্ষিণ সিটিতে, ঢাকার বাইরে শীর্ষে চট্টগ্রাম ডেঙ্গুর ভয়াল রূপ সেপ্টেম্বরে, আট মাসের সমান মৃত্যু এক মাসে ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার বিভাগের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন

ওই ডেঙ্গু ওয়ার্ডের একজন নার্স জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, এই ওয়ার্ডে ৬২ জনের মতো রোগী ভর্তি। তবে শয্যা মাত্র ২০ জনের। রোগীর চাপ সামাল দিতে তাদের হিমশিম অবস্থা।

Advertisement

ঢাকার হাসপাতালগুলোর কর্তব্যরত চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে যারা এখন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই ঢাকার বাসিন্দা। তবে ২০-২৫ শতাংশ রোগী ঢাকার বাইরে থেকেও আসছেন।

ঢামেকের পর সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুরোগীর চাপ দেখা গেছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও কোনো শয্যা ফাঁকা নেই। এছাড়া শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগীর আধিক্য রয়েছে।

ডেঙ্গু নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সত্যজিৎ সাহা জাগো নিউজকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে গত বছরের তুলনায় এবার মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে মনে হচ্ছে। রোগীরা জ্বর আসার দু-একদিনের মধ্যে পরীক্ষা করিয়ে পজিটিভ হলেই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই ঢাকার বাসিন্দা। তবে ২০-২৫ শতাংশ রোগী ঢাকার বাইরে থেকেও আসছেন

তিনি বলেন, ডেঙ্গুরোগীদের ক্ষেত্রে রক্তের প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে শুধু প্লাটিলেট কমে যাওয়া নয়, ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েও রোগী মারা যায়। তাই প্লাটিলেটের সংখ্যা ১০ হাজারের ওপরে থাকলে ও রক্তপাত (অ্যাকটিভ ব্লিডিং) না থাকলে, এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।

বেশি চাপ চার সরকারি হাসপাতালে

রাজধানীর ১৮টি সরকারি হাসপাতালকে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এসব হাসপাতালে বর্তমানে ভর্তি রোগী সংখ্যা ৯৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৪৯৯ জনই চিকিৎসা নিচ্ছেন চারটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

সরকারের ডেঙ্গুবিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৩০ হাজার ৯৩৮ জন ডেঙ্গুরোগী চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ১৩ হাজার ৫০৮ জন ও ঢাকার বাইরে ভর্তি হন ১৭ হাজার ৪৩০ জন।

এই ৯ মাসে রাজধানীর নির্ধারিত সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন আট হাজার ২৩৯ ডেঙ্গুরোগী। তাদের মধ্যে শুধু চারটি হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়েছে চার হাজার ৯৩৪ রোগী, যা ঢাকার সরকারি হাসপাতালে ভর্তি মোট ডেঙ্গুরোগীর ৬০ শতাংশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, চলতি বছরের শুরু থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩০ হাজার ৯৩৮ জন। তাদের মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বরেই আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ হাজারের বেশি মানুষ। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত মাসের প্রথম সপ্তাহে আক্রান্তের হার ছিল ১৪ শতাংশ। মাসের শেষ সপ্তাহে দেখা যাচ্ছে, তা বেড়ে হয়েছে ২৪ শতাংশ। বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। সেপ্টেম্বরের প্রথম ৭ দিনে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারান ১১ জন। আর শেষ ৭ দিনে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩০ জন।

অক্টোবরে ভয়াল রূপ নিতে পারে ডেঙ্গু

এ অবস্থায় অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কীটতত্ত্ববিদরা। এমনকি তা আগে ৯ মাসের সব রেডর্ক ছাপিয়ে যেতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার জাগো নিউজকে বলেন, আমি আগেই বলেছি সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা বাড়বে। এ সংখ্যাটি হঠাৎ করে বাড়েনি। তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় প্রশাসন এখনো কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ অবস্থায় অক্টোবরে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আরও বাড়তে পারে।

আরও পড়ুন একদিনে সারাদেশে মশার ৮ হাজার প্রজননস্থল ধ্বংস ডেঙ্গু কাড়লো আরও ৫ প্রাণ, নতুন রোগী ১১৫২ হার্টের রোগীর চাপ বাড়ছে ঢাকায়, বাড়ছে না চিকিৎসার পরিসর

বছরের আগের মাসগুলোর তুলনায় আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে হওয়া অতিবৃষ্টিকে এই দুই মাসে ডেঙ্গুরোগী বাড়ার কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তথ্য বলছে, এ বছর আগস্টে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেপ্টেম্বরেও বৃষ্টির পরিমাণ একেবারে কম ছিল না।

বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে এলে এক মাসের মধ্যেই সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তবে এ মুহূর্তে ডেঙ্গুর হটস্পট নির্ধারণ করে সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে।- অধ্যাপক কবিরুল বাশার

অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়ে গেলে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হয় উড়ন্ত মশা নিধনে। আমরা এখনো এ ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়ছে। অক্টোবরে এটি আরও ভয়ংকর রূপ নিতে পারে।

কবে নাগাদ ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে এলে এক মাসের মধ্যেই সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তবে এ মুহূর্তে ডেঙ্গুর হটস্পট নির্ধারণ করে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।

ডেঙ্গুর হটস্পট নির্ধারণে নেই উদ্যোগ

ডেঙ্গুর মৌসুমে কোন কোন এলাকায় এডিস মশার আধিক্য বেশি তা নির্ধারণ করতে করা হয় ডেঙ্গু জরিপ। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালনায় প্রতি বছর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা তিন দফায় ডেঙ্গুর লার্ভা জরিপ করে তা স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে বর্ষাপূর্ব জরিপ হয়েছিল। কিন্তু বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী জরিপ এখনো হয়নি। গত বছর অক্টোবরের মধ্যে এই দুই পর্যায়ের জরিপ সম্পন্ন করেছিল সরকার।

এএএম/এমকেআর/এএসএম