১৯৯০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা ১ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের মূল কারণ ছিল বিশ্বের জনসংখ্যায় বয়স্ক মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এবং তাদের ভূমিকাও ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। রেজোলিউশন ৪৫/১৬০ এর মাধ্যমে এই দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হয়।
Advertisement
১৯৮২ সালের ভিয়েনা আন্তর্জাতিক কর্মপরিকল্পনা এবং ১৯৯১ সালে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য জাতিসংঘের নীতি গ্রহণের মতো উদ্যোগগুলি বয়স্ক ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই উদ্যোগগুলি বয়স্ক ব্যক্তিদের সমাজের মূলধারায় রাখতে এবং তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে আমাদের প্রতিশ্রুতির প্রমাণ স্বরূপ।
২০০২ সালে বার্ধক্য সম্পর্কিত দ্বিতীয় বিশ্ব সম্মেলনে আরও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, যা ২১ শতকে জনসংখ্যার বার্ধক্যজনিত চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করতে মাদ্রিদ ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান অফ অ্যাকশন অন এজিং চালু করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত এই বছরের থিম, "Ageing with Dignity: The Importance of Strengthening Care and Support Systems for Older Persons Worldwide" গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক যার বাংলা প্রতিপাদ্য করা হয়েছে “মর্যাদাপূর্ণ বার্ধক্য: বিশ্বব্যাপী প্রবীণ পরিচর্যা ও সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ” যা বিশ্বজুড়ে সমাজে বয়স্ক ব্যক্তিদের মঙ্গলকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১৯৮০ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। এই সময়কালে তাদের সংখ্যা প্রায় ২৬ কোটি থেকে ৭৬ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন যে, ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা আরও দ্বিগুণ হয়ে ১৬০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
Advertisement
বাংলাদেশে বয়স্ক জনসংখ্যার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ২০২২ সালে ৫.৬৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ৬.১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
অনুমান করা হচ্ছে যে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ৩৬ মিলিয়নে পৌঁছাবে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২%। এই প্রবণতা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রতি ছয়জন মানুষের মধ্যে একজনের বয়স ৬০ বছর বা তার বেশি হবে। বয়স্ক জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ার কারণে, তাদের যথাযথ যত্ন নিশ্চিত করার জন্য দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
বিশ্বব্যাপী ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এই দ্রুত বৃদ্ধি স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সুরক্ষা এবং অর্থনীতির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। একই সাথে, এটি বয়স্কদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগানোর নতুন সুযোগও সৃষ্টি করছে।
মানুষের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির ফলে বিশ্বের অর্ধেক দেশে ৭৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে সারা জীবন সুস্থ থাকা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো এবং বৃদ্ধ বয়সেও মানসম্মত জীবনযাপনের জন্য যথাযথ চিকিৎসা ও যত্ন পাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
Advertisement
বয়স বাড়ার সাথে সাথে শুধু শারীরিক পরিবর্তনই হয় না, বরং আমরা যে সমাজে বাস করি, সেই সমাজের প্রভাবও বয়সের উপর পড়ে। একটি সহায়ক পরিবেশ বয়স্কদের স্বাধীনতা এবং সক্রিয়তা বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং তাদের জীবনকে আরও সুখী করে তোলে।
একজন ব্যক্তির জীবনযাত্রার মান নির্ধারণে শুধু তার শারীরিক সক্ষমতা নয়, তার চারপাশের পরিবেশের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বয়স্ক ব্যক্তিরা যাতে মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকতে পারেন এবং সমাজের জন্য কাজ করতে পারেন, সেজন্য আমাদের সবারই একসঙ্গে কাজ করে এমন পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে যেখানে তাদের বাড়ি, আশেপাশের এলাকা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান সব মিলে তাদের জীবনকে আরও সহজ ও সুন্দর করে তুলবে।
একজন ব্যক্তির জীবনযাত্রার মান নির্ধারণে শুধু তার শারীরিক সক্ষমতা নয়, তার চারপাশের পরিবেশের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বয়স্ক ব্যক্তিরা যাতে মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকতে পারেন এবং সমাজের জন্য কাজ করতে পারেন, সেজন্য আমাদের সবারই একসঙ্গে কাজ করে এমন পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে যেখানে তাদের বাড়ি, আশেপাশের এলাকা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান সব মিলে তাদের জীবনকে আরও সহজ ও সুন্দর করে তুলবে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সহায়তার চাহিদাও বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে, ডিমেনশিয়া যেমন দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য আরও বেশি যত্নের প্রয়োজন হচ্ছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শারীরিক অক্ষমতা এবং অন্যের উপর নির্ভরশীলতা বাড়ার কারণে এই চাহিদা আরও বেড়েছে।
বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের বিশেষ চাহিদা মেটাতে স্বাস্থ্যসেবা ও যত্নের ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়ছে। বয়স্কদের স্বাস্থ্য রক্ষা এবং দীর্ঘ জীবন যাপনের জন্য রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা এবং দীর্ঘমেয়াদী যত্নের ব্যবস্থা গড়ে তোলা আজকের দিনের গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এই সমস্যা মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী একটি কার্যকর পদ্ধতির প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে, পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব প্রায়শই মহিলাদের ওপর পড়ে। অনানুষ্ঠানিক যত্নের কাজে মহিলারা প্রায় ৭০% সময় ব্যয় করেন, যার ফলে তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সীমিত হয়ে পড়ে। এই অবস্থা পরিবর্তন করা জরুরি।
ফলস্বরূপ, বৃদ্ধ বয়সে মহিলারা দ্বিগুণ কষ্ট ভোগ করেন; একদিকে তারা নিজেরাই যত্নের অভাবে ভোগেন আবার অন্যদিকে অন্যের যত্ন নেওয়ার দায়িত্বও পালন করতে বাধ্য হন। এই অসাম্যের কারণে বয়স্ক মহিলারা দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে আরও বেশি পড়েন। সকল বয়স্ক ব্যক্তির জন্য যথাযথ যত্ন নিশ্চিত করতে হলে এই লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা অত্যন্ত জরুরি।
বার্ধক্যের সাথে মানুষের শরীর ও মনে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে, যা অনেক সময় আগে থেকেই আন্দাজ করা যায় না। কারণ শরীরের কোষ ও অণুতে ধীরে ধীরে ক্ষতি হতে থাকে, যার ফলে শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা কমতে শুরু করে।
বয়স্কদের মধ্যে শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া, চোখের ছানি, অস্টিওআর্থারাইটিস, দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগ, ডায়াবেটিস এবং ডিমেনশিয়া খুবই সাধারণ সমস্যা। এছাড়াও, দুর্বলতা, প্রস্রাব আটকাতে না পারা এবং পড়ে যাওয়াও বয়স্কদের মধ্যে ঘন ঘন দেখা যায়। এই সব সমস্যার কারণ একাধিক হতে পারে। এই সব স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য বিশেষ ধরনের চিকিৎসা ও যত্নের প্রয়োজন।
দীর্ঘায়ু একজন ব্যক্তির জন্য এবং সমাজের জন্য নানা সুযোগের দ্বার উন্মুক্ত করে। বয়স্ক ব্যক্তিরা তাদের পরিবার ও সমাজে অবদান রাখতে পারেন, নতুন কাজ শিখতে পারেন এবং এমনকি নতুন কর্মজীবন শুরু করতে পারেন। তবে, এই সুযোগগুলো কতটা কাজে লাগানো যাবে, তা নির্ভর করে বয়স্ক ব্যক্তিটির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর।
দুর্ভাগ্যবশত, মানুষ দীর্ঘদিন বাঁচলেও সবসময় সুস্থ থাকে না। অনেকেরই বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন রোগ বা শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, যার ফলে তারা আগের মতো সক্রিয় থাকতে পারে না। তাই শুধু দীর্ঘ জীবন নয়, সুস্থ জীবন যাপন করাও খুবই জরুরি। বয়স্কদের সুস্থ রাখার মাধ্যমে আমরা না শুধু তাদের জীবনমান বাড়াতে পারি, বরং স্বাস্থ্যসেবার খরচও কমাতে পারি।
মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের চারপাশের পরিবেশটি তাদের জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করে। বাড়ি, সম্প্রদায় এবং জনসাধারণের স্থানগুলো যদি বয়স্কদের চলাচল ও কাজ করার জন্য উপযোগী হয়, তাহলে তারা বয়স বাড়ার সাথে সাথেও স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন। তাই, জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে শুধু রোগের চিকিৎসা নয়, বরং বয়স্কদের জন্য এমন পরিবেশ গড়ে তোলাও জরুরি যাতে তারা মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে এবং স্বাধীনভাবে নিজেদের কাজ করতে পারে।
“মর্যাদাপূর্ণ বার্ধক্য: বিশ্বব্যাপী প্রবীণ পরিচর্যা ও সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ” এই থিমটি ২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে আমাদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছে। বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে, বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য যথাযথ যত্ন ও সহায়তা নিশ্চিত করা আরও জরুরি হয়ে পড়েছে।
এই বছরের থিমটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করে, যাতে বয়স্কদের যত্নের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি না থাকে। এটি জেরিয়াট্রিকস ও জেরোন্টোলজি বিষয়ে প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেয় এবং যত্নদাতাদের সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। একইসাথে, এই থিমটি বয়স্কদের মানবাধিকার রক্ষা এবং তাদের ব্যক্তিগত চাহিদা মেটানোর ওপর জোর দেয়।
আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস সরকার, নীতি নির্ধারক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি মঞ্চ প্রদান করে, যেখানে তারা বৃদ্ধ বয়সের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে এবং সমাধানের উপায় খুঁজে বের করে। বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের যথাযথ যত্ন ও সহায়তা নিশ্চিত করা আজকের সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে, যত্নদাতাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং বয়স্কদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে তারা মর্যাদা ও স্বাধীনতার সাথে বার্ধক্যকাল অতিবাহিত করতে পারবেন।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
এইচআর/জিকেএস