বিশেষ প্রতিবেদন

হেফাজতের তাণ্ডব : ৯৫ শতাংশ মামলারই সুরাহা হয়নি

আজ ৫ মে। রাজধানী মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ওই দিনে হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক তাণ্ডবের ঘটনায় দায়ের করা ৯৫ শতাংশ মামলারই সুরাহা করতে পারেনি পুলিশ। গত তিন বছরে মাত্র তিনটি মামলার চার্জশিট দিতে পেরেছে পুলিশ। মোট ৫৩ মামলার ৫০টিই রয়েছে হিমঘরে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।সূত্র জানায়, থানা পুলিশের হাতে রয়েছে ৩৫টি মামলা। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে রয়েছে ১৫টি। থানা পুলিশের চাইতে ডিবির দায়িত্বে থাকা ১৫ মামলা তদন্তের অবস্থা আরও করুন। এখন পর্যন্ত থানা পুলিশই ৩টি মামলার চার্জশিট দিয়েছে। দীর্ঘ ৩ বছরেও মামলাগুলোর তদন্ত শেষ না হওয়ায় হেফাজতের সঙ্গে `সমঝোতা`র অভিযোগও উঠেছে নানা মহলে। গতিহীন তদন্তের মধ্যেই আসামিদের প্রকাশ্যে নানা কর্মসূচিতে অংশ নিতেও দেখা গেছে। খুব সম্প্রতি রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের দাবিতে কয়েক দফা রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করতে দেখা যায়। সরকারও ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কৌশল হিসেবে হেফাজতকে নতুন করে উস্কে দিতে আগ্রহী হচ্ছে না বলেও দাবি অনেকের। আবার পুলিশেরই একটি সূত্রের দাবি, সরকারের গ্রিন সিগন্যাল পেলেই মামলা গুলো চাঙ্গা হয়ে উঠবে। আসামিরা সবাই সনাক্ত। কে কোথায় আছেন সে তথ্যও পুলিশের কাছে রয়েছে।মামলার এজাহারের বিবরণ ও হিসাব অনুযায়ী, সমাবেশের নামে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের তাণ্ডবে ভস্মীভূত হয়েছে ৫ হাজারেরও বেশি দোকান, ব্যাংক, একাধিক ব্যাংকের এটিএম বুথ, সরকারি গাড়ি, বাস, মোটরসাইকেল, পিকআপসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অর্ধশতাধিক কোটি টাকা। হাজার হাজার বই ও পবিত্র কোরআন-হাদিসেও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। কেটে ফেলা হয়েছিল রাস্তার সৌন্দর্য বর্ধনকারী শত শত গাছ। ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচির নামে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নেমে আসে অরাজক পরিস্থিতি। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, মামলার এজাহারে আসামিদের অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন। আবার অনেকে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। অনেকের নাম জানা যায়নি। সারাদেশ থেকে লোকজন ঢাকায় আসায় তাদের নাম পরিচয় খুঁজে বের করা সহজ নয়। তাই সময় লাগছে। তবে মামলাগুলোর তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসামিদের বেশির ভাগই চিহ্নিত। হামলার প্রথম বছরে তদন্ত বেশ এগিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে উপরের নির্দেশেই তদন্তে গতি হারায়। এর বদলে গত তিন বছরে বিএনপি-জামায়াতের নাশকতার মামলা দেখতে বেশি ব্যস্ত সময় পার করতে হয়েছে পুলিশকে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মারুফ হোসেন সরদার জাগো নিউজকে বলেন, মতিঝিলে ৩টি, পল্টন থানায় ২৩টি, রমনা ২টি, শাহবাগে ৩টি, যাত্রাবাড়ীতে ৩টি ও কামরাঙ্গির চরে ৩টি মামলা দায়ের করা হয়। এরমধ্যে পরবর্তীতে ১৫টি মামলার তদন্ত দায়িত্ব নেয় ডিবি পুলিশ। ৫৩টি মামলার মধ্যে রমনা থানার একটি ও কলাবাগান থানার দুটি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অন্য মামলাগুলোর মধ্যে থানা পুলিশ ৩৫টি ও ডিবি পুলিশ ১৫টির তদন্ত করছে। তদন্ত শেষ হলেই চার্জশিট দাখিল করা হবে বলেও জানান তিনি। ডিএমপি’র একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবু নগরীসহ অন্তত ৭৮ জনকে একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাদের অনেকে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছেন। তবে গত তিন বছরে গ্রেফতার প্রায় সবাই জামিনে রয়েছে।ডিবির হাতে তদন্তে থাকা মামলার মধ্যে পুলিশের উপ-পরিদর্শক এসআই শাহজাহান হত্যা মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার ও রফিকুল ইসলাম মিয়া গ্রেফতারও হয়েছিলেন। এ ব্যাপারে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ কর্তৃক ইসলাম অবমাননা প্রশ্নে `হেফাজতে ইসলাম` গড়ে উঠে। এরপরই ধর্মনির্ভর সংগঠনটি গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে তাদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে মাঠে নামে। ওই বছরের ৬ এপ্রিল ঢাকামুখী লংমার্চ কর্মসূচি দিয়ে তারা আলোচনায় আসে। পরের মাসেই (৫ মে) ঢাকা ঘেরাও এবং মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি দিয়ে বসে সংগঠনটি। সরকার দলের অভিযোগ, হেফাজতের ওই কর্মসূচিতে নেপথ্যে থেকে ইন্ধন দিয়েছে বিএনপি ও জামায়াত। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্ত অবস্থানে মধ্যরাতের অভিযানে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হয় হেফাজতের নেতাকর্মীরা। পুলিশের দাবি, ওই সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে হেফাজতের সাত কর্মী, এক পুলিশ সদস্য এবং তিনজন সাধারণ মানুষসহ মোট ১১ জন নিহত হন। তবে হেফাজতের পক্ষ থেকে এবং একটি বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা মৃত্যুর সংখ্যা আড়াই থেকে ৩ হাজার বলে দাবি করে।জেইউ/জেএইচ/আরআইপি

Advertisement