বর্ষাকাল এলেই বেড়ে যায় ডেঙ্গু। মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে। মে-জুনে বৃষ্টি কম হওয়ায় সেভাবে ডেঙ্গু না বাড়লেও সেপ্টেম্বরে এসে টানা বৃষ্টি ও পরিবেশের কারণে এটি আবারও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এ বছর এখন পর্যন্ত সাধারণ উপসর্গের বা ক্ল্যাসিকাল ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি।
Advertisement
ডেঙ্গু রোগীদের বিশেষায়িত চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে রাজধানীর মহাখালীর ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড ১৯ হাসপাতালে। দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় গত বছর এই হাসপাতালটি ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়। বর্তমানে সব বয়সী ডেঙ্গু রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এখানে।
মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, দ্বিতীয় ও তৃতীয়তলায় ডেঙ্গু রোগী ভর্তি। এছাড়া পঞ্চমতলায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রেও (আইসিইউ) ডেঙ্গু রোগী আছে। শিশুদের ওয়ার্ডে টানানো আছে মশারি। রোগীদের সেবায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।
রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিকিৎসা সেবায় তারা সন্তুষ্ট। কোনো অসুবিধা আছে কি না তা দেখার জন্য হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্বাবধান চলছে।
Advertisement
হাসপাতালে এখনো ডেঙ্গু রোগীর অতিরিক্ত চাপ দেখা যায়নি। চিকিৎসাধীন অধিকাংশ রোগীকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল থেকে এখানে স্থানান্তর করা হয়েছে।
মহাখালীর এই হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা ভালো হয়। তবে সেই তথ্য না জানায় এখানে সরাসরি রোগী আসছে না বলে মনে করছেন হাসপাতালের কর্মকর্তারা।
হাসপাতালের দ্বিতীয়তলায় ভর্তি ২২ মাস বয়সী আছিয়া। সকাল থেকে কয়েক দফায় নাক দিয়ে রক্ত বের হয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুকন্যার এই দুরবস্থায় চরম উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন শিশুটির মা পারভীন।
পারভীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আছিয়ার বিভিন্ন সমস্যা আছে। বয়সের তুলনায় ওজন কম। প্রস্রাবে ইনফেকশন আছে। পাবনা থেকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা শিশু হাসপাতালে এনেছিলাম। সেখানে সুস্থ হয়ে উঠলে বাড়ি যাওয়ার জন্য বাসের টিকিট কাটি। ওই দিন বিকেলে হঠাৎ তার অনেক জ্বর আসে, ১০১ ডিগ্রি।’
Advertisement
‘পরে টিকিট বাতিল করে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যাই। সেখানে বিভিন্ন টেস্ট করার পর ডেঙ্গু ধরা পড়ে। পরে দেরি না করে এই হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা হয় জেনে আছিয়াকে নিয়ে আসি। ২০ সেপ্টেম্বর থেকে এখানেই ভর্তি সে। সোমবার রাতেও ভালো অবস্থা দেখছিলাম। কিন্তু সকালে (মঙ্গলবার) ঘুম থেকে ওঠার পর দেখি তার নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। পরে মাথায় পানি দেই। ডাক্তারও দেখে যান। এরপর একটু বন্ধ হয়। দুপুরে কাশির সঙ্গে আবারও রক্ত আসে।’ বলছিলেন পারভীন।
আরও পড়ুন
ডেঙ্গুতে একদিনে ৬ মৃত্যু, হাসপাতালে সর্বোচ্চ ৯২৬ রোগী ডেঙ্গুতে একদিনে বছরের সর্বোচ্চ ৬ জনের মৃত্যু ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে মশা মারতে কাজ করছেন ৩ হাজার কর্মীউত্তর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা মোসাম্মৎ আয়েশা আক্তার। দুই শিশুসন্তান ও স্বামীসহ পুরো পরিবার নিয়ে অবস্থান করছেন হাসপাতালে। এর মধ্যে ছয় বছর বয়সী ছেলে আবির হাওলাদার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। বাবা-মা ছাড়া দুই শিশুকে দেখার মতো আর কেউ না থাকায় সবাই আছেন হাসপাতালে।
আয়েশা আক্তার বলেন, ‘আবির মাদরাসায় হিফজ বিভাগে পড়ছে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে জ্বরে ভুগছে। গত বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) রাতে হাসপাতালে নিয়ে আসি। আগের দিন এলাকায় বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা করছিল। হঠাৎ ওই দিন বিকেল থেকে অসুস্থতা অনুভব করে। রাতে জ্বর বেড়ে যায়, বমি হয়, শরীর দুর্বল হয়ে যায়। এলাকায় চিকিৎসা করিয়েছি। পরে অবস্থা ভালো না হওয়ায় এখানে নিয়ে আসি। এখন অবস্থা অনেকটা ভালো।’
এবার ডেঙ্গুতে গত বছরের তুলনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার এখন পর্যন্ত কম হলেও ধীরে ধীরে এই হার বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) রেকর্ড ৯২৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এছাড়া এদিন এ বছর একদিনে সর্বোচ্চ ছয়জন রোগী মারা যায়।
আরও পড়ুন
কক্সবাজারে গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ২৩ হাজার ছাড়ালো চট্টগ্রাম মেডিকেলে চালু হচ্ছে বিশেষায়িত ডেঙ্গু ওয়ার্ডডিএনসিসির ডেঙ্গু হাসপাতালের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, ২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে নতুন ৩৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে ছাড়া পেয়েছে ৪১ জন। হাসপাতালে ভর্তি আছে ১২২ জন ডেঙ্গু রোগী। এছাড়া আইসিইউতে আছে ২০ জন।
হাসপাতালটিতে গত এক মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা নিয়মিতই বেড়েছে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৩০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে একজন।
হাসপাতালের নার্স স্বপ্না জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবার বেশিরভাগ রোগীর ডেঙ্গুর সাধারণ যে বৈশিষ্ট্য থাকে তা দেখা যাচ্ছে। যেমন- প্লাটিলেট কমে যাওয়া, রক্ত পড়া, বমি হওয়া, গায়ে র্যাশ ওঠা, মাথা ঘোরা, দুর্বল হয়ে পড়া, পানিশূন্যতা এসব।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. তুষার কান্তি বর্মণ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই মাসের প্রথমদিকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জন ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হতেন। তবে মাঝামাঝি সেটি বেড়ে ২০ থেকে ২৫ জন হয়। চলতি সপ্তাহে এসে দেখছি প্রতিদিন গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। মাসের শেষদিকে রোগীর ঊর্ধ্বগতি দেখতে পাচ্ছি।’
চলতি বছর ডেঙ্গুর ধরন প্রসঙ্গে ডা. তুষার বলেন, ‘গত বছর আমরা সাধারণ ক্ল্যাসিকাল ডেঙ্গু ছাড়াও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখেছি, এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু দেখেছি। তবে এ বছর ক্ল্যাসিকাল ডেঙ্গুর পরিমাণটাই বেশি। বেশিরভাগেরই জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা- এ ধরনের সিমটম বেশি। আগের বছর যেমনটা হয়েছে হঠাৎ করে প্রেশার লো হয়ে যাওয়া, রক্তক্ষরণ এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। এ বছর তা অনেক কম পাচ্ছি। আমরা বলতে পারি এ বছর ক্ল্যাসিকাল ডেঙ্গু রোগীই বেশি। সে কারণেই এ বছর রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে সহজে সুস্থ করা সম্ভব হচ্ছে। মৃত্যু একটু কম হচ্ছে।’
এএএম/ইএ/এমএমএআর/এমএস