খেলাধুলা

‘মুস্তাফিজ তো আমার একার না, সারা দেশের’

মুস্তাফিজুর রহমান। সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ ইউনিয়নের তারালি ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া গ্রামে একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম তার। বয়সটা খুব বেশি নয়। মাত্র ২০ পার করছে। এতটুকুন বয়সেই বিশ্ব কাঁপিয়ে দিয়েছেন সুন্দরবনের কোলঘেঁষে বেড়ে ওঠা লিকলিকে গড়নের এই তরুণটি। তার বাঁ-হাতে সত্যিই কী জাদু আছে! না হয় কেন বিশ্বের সেরা সেরা ব্যাটসম্যানরা তার ছুড়ে দেয়া বলগুলোতে বিভ্রান্ত হতে থাকে! কত আধুনিক উপকরণ, কত গবেষণা হচ্ছে ক্রিকেট নিয়ে। ব্যাটসম্যানরা গবেষণা করে করে বের করে ফেলেছেন বোলারদের সব ধরনের কারিকুরি। সেখানে  কোথাকার কোন মুস্তাফিজ অজ পাড়া-গাঁ থেকে উঠে এসে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে তাবৎ বিশ্বের সেরা সেরা ব্যাটসম্যানদের।সেই মুস্তাফিজ মাত্র এক বছরের মাথায় চলে গেলো ভারতের মাল্টি বিলিয়ন ডলারের টুর্নামেন্ট আইপিএল খেলতে। সানরাইজার্স হায়দারাবাদ যেমনই পারফরম্যান্স করুক, মুস্তাফিজ ঠিকই নিজেকের তারকামূল ধরে রেখেছেন। কেকেআরের বিপক্ষে তাদের ব্যাটসম্যান আন্দ্রে রাসেল যেভাবে মাটিতে আছড়ে পড়েছেন মুস্তাফিজের ইয়র্কারে, সেটা নিশ্চিতই বিধ্বংসী ক্রিকেটের বিজ্ঞাপন হয়ে থাকবে সারাজীবন।ছেলে ঘুরে ঘুরে পুরো ভারতবর্ষ মাতিয়ে বেড়াচ্ছে আর সাতক্ষীরার অজ পাড়া গাঁয়ে বসে তার জন্য নিয়তই হাত তুলে বসে থাকছেন বাবা আবুল কাশেম গাজী। পরিবারের ছোট ছেলে। যে কারণে মা-বাবার টান একটু বেশিই। তার ওপর, এই প্রথম বিদেশে এমন একটা সফরে গিয়েছে, যেখানে মুস্তাফিজের চেনা-জানা কেউ নেই। সঙ্গী-সাথী কেউ নেই। ভাষার সমস্যা যেখানে প্রকট। তার কথা কেউ বুঝতে পারছে না। দোভাষী নিয়োগ দিতে হয়েছে সানরাইজার্সকে।শুধু ভাষাগত সমস্যা নয়, প্রচণ্ড গরমও হায়দারাবাদে সমস্যায় ফেলছে মুস্তাফিজকে। খাওয়া-দাওয়া সমস্যাও রয়েছে কিছুটা। জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে মুস্তাফিজের বাবা আবুল কাশেম গাজী জানালেন, প্রতিদিনই কথা হয় ছেলের সঙ্গে। প্রতিদিনই নিজের ভালো-মন্দ জানান তিনি মা-বাবা, ভাইকে। তবে অসুবিধাগুলোর কথা খুব বেশি বলেন না। যদি মামা-বাবা চিন্তা করেন, এ জন্য। তবুও ছেলে কথা শুনলে বাবা আবুল কাশে গাজী অনেক কিছু বুঝতে পারেন। বিস্তারিত না বললেও বোঝেন, হায়দারাবাদে কিছুটা সমস্যা তো হয়ই তার।মূলতঃ আইপিএলের ক্রিকেটারদের যে উদ্দাম জীবন-যাপন পদ্ধতি, তার সঙ্গে একেবারেই নতুনভাবে পরিচিত হয়েছেন মুস্তাফিজ। এসবের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়া তো খুব সহজ নয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে খাওয়া-দাওয়ায়ও সমস্যা হয় তার। এমনটাই জানিয়েছেন আবুল কাশেম গাজী।৩০ এপ্রিল রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে মুস্তাফিজের মাঠে নামার আগে জাগো নিউজের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি আকরামুল ইসলামের মাধ্যমে কথা হয় মুস্তাফিজের বাবা আবুল কাশেম গাজীর সঙ্গে। তখন নানা বিষয় নিয়েই তিনি কথা বলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। জানান, মাঝে-মধ্যে বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে ছেলের খেলা দেখতে পারেন না তিনি এবং মুস্তাফিজের মা, ভাইরা।জীবনে কখনও ক্রিকেট খেলা দেখা হয়নি আবুল কাশেম গাজীর। এসব নিয়ে আগ্রহও কখনও তৈরী হয়নি তার। তবে ছেলের কারণে এখন একটু-আধটু দেখা হয়। ছেলের সাফল্যে আনন্দিত হন। সবার সঙ্গে হাততালি দেন। যদিও তার এবং তার ছেলেদের সামনে বাইরের কেউ এসে বসে টিভি দেখবে, সে সাহস হয় না। মুস্তাফিজের খেলা থাকলে বাড়ির সবাইকে নিয়ে টিভির সামনে বসে যান সবাই। তখন সবাই মিলে উপভোগ করেন সেটা। তবে বাইরে কোথাও গেলে, ছেলের খেলা থাকলেও খেলা দেখা হয় না আবুল কাশেম গাজীর।ছেলে এতবড় তারকা হয়ে গেছে। সারা বিশ্বের সবাই এক নামে চেনে। বিষয়টা কেমন লাগে জানতে চাইলে মুস্তাফিজের বাবা বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ ভালো। এটা আল্লাহর তরফ থেকে ফায়সালা হয়ে এসেছে। সে আমার ছেলে না! ভালো তো লাগবেই।’সে তো এখন আর আপনার একার ছেলে নয়, সারা বাংলাদেশের ছেলে। মুস্তাফিজের বাবার জবাব, ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। এখন তাকে আমার একার ছেলে বললে আসলে ভুল হবে। সে তো এখর আর আমার নেই, সে এখন পুরো দেশের, ১৬ কোটি মানুষের সন্তান। সবাই দোয়া করলে আমার বিশ্বাস সে আরও ভালো করবে ইনশাআল্লাহ।’ছেলে তো আইপিএলে খেলতে গেছে। তো তার সঙ্গে কী প্রতিদিন যোগযোগ হয়? ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। প্রতিদিনই তার সঙ্গে কথা হয়। মাঠে যাওয়ার আগে সে আমার সঙ্গে কথা বলে। দোয়া চায়। তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে দোয়া চায়। আজও (৩০ এপ্রিল) যেমন খেলার জন্য মাঠে যাওয়ার আগে আমাকে ফোন করেছে। আব্বা-আম্মার কাছে দোয়া চেয়েছে। যতগুলো খেলা হয়, সবসময়ই আমার কাছ থেকে দোয়া চেয়ে তবে মাঠে নামে। কখনও আমার সঙ্গে কথা না বলে মাঠে যায় না। আমরাও সব সময় দোয়া করি। সন্তানের জন্য তো বাবা-মা দোয়া করবেই। আর তার জন্য তো এখন আমার বিশ্বাস, সারা দেশের মানুষই দোয়া করে।’ মুস্তাফিজকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখা হয়, টিভিতে প্রচার হয় এগুলো দেখেন? ‘পেপার-পত্রিকা তো খুব একটা আমাদের এদিকে আসে না। আমরা তো একটু নিম্ন এলাকায় (প্রত্যন্ত গ্রামে) থাকি! এ কারণে পত্রিকা আসে না। দুটা পত্রিকা আসে দৃষ্টিপাত এবং মশাল নামে (সাতক্ষীরার স্থানীয় পত্রিকা)। ওগুলোতে দেখি।’ ভারতে মুস্তাফিজ কেমন আছে? ‘হ্যাঁ ভালো আছে। ছেলে মানুষ তো! নতুন সফরে গিয়েছে। একটু-আধটু সমস্যা হচ্ছেই। ভাষার সমস্যা তো আছেই। গরমও সমস্যা করছে। থাকা নিয়েও একটু সমস্যা হয়। এছাড়া আর কোন সমস্যা হয় না। আসলে আমার কাছে সবকিছু বলেও না। তবে ওর কথা শুনলে আমি বুঝি। জিজ্ঞাসা করলে, বলে ভালো আছি। আপনারা দোয়া করবেন। তাহলে আরও ভালো থাকবো।’বাবা হিসেবে মুস্তাফিজকে কোথায় দেখতে চান? জবাবে আবুল কাশেম গাজী বলেন, ‘কী বলবো বলেন! মানুষ সবাই যেমন তার সন্তানের ভালো চায়, আমিও চাই। সবাই দোয়া করবেন যেন, আমার ছেলে আরও ভালো করতে পারে। যেন বাংলাদেশের মুখকে আরও উজ্জ্বল করে আনতে পারে। সামনে বিশ্বকাপ আছে, আরও অনেক অনেক খেলা আছে। সেগুলোতে যেন সে ভালো খেলতে পারে, দেশের জন্য ভালো করতে পারে- এটাই আমি কামনা করি।’মুস্তাফিজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেছে তো এক বছর হলো। এরমধ্যে দু’বার ইনজুরিতে পড়েছে। ভারতের আইপিএলের পর ইংল্যান্ডে যাবে। এরপর আরও অনেক টুর্নামেন্ট আসবে। তো ইনজুরিতে যেন না পড়ে, এ জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে তার কাছে কোন পরামর্শ দেয়া হয়? ‘আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কিছু বলার নেই। সে যেটা ভালো মনে করবে, সেটা করবে। আমরা শুধু দোয়া করবো যেন সে ভালো থাকে, আরও ভালো করে। ইনজুরিমুক্ত থাকার জন্য তো অবশ্যই দোয়া করবো।’ছেলে বড় তারকা হয়ে গেছে। এ কারণে সবাই এখন আপনার কাছে আসে, সবাই আপনার সাথে কথা বলতে চায়, এ বিষয়টা কেমন লাগে আপনার কাছে? ‘অনেক ভালো লাগে। আগে যখন সে খেলতো না, তখন তো কেউ আসতো না আমার কাছে। এখন আল্লার তরফ থেকে ছেলে খেলে বড় তারকা হয়েছে। মানুষও আমার কাছে আসে। এটা তো আমার কাছে বড় পাওনা।’আইএইচএস/এবিএস

Advertisement