ফিচার

এখনো মনে আছে মীনা-রাজু-মিঠুকে?

ঝকঝকে সুন্দর ছবির মতো এক গ্রাম। যেখানে আছে নদী, গাছ, পাখি, আর সহজ সরল মানুষজন। এই গ্রামেই বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদিকে নিয়ে বাস করে মীনা। ৯ বছরের মীনা তার ভাই রাজু ও পোষা টিয়া পাখি মিঠুর সঙ্গেই খেলে, স্কুলে যায়, বাড়ির কাজ করে। এছাড়াও তাদের পরিবারে আছে গরু লালী, ছাগল মুনমুন।

Advertisement

৯০ দশকের ছেলেমেয়েদের শৈশবের বড় একটি অংশ জুড়ে আছে এই মীনা কার্টুন সিরিজ। এখনো মীনার কার্টুন সমান জনপ্রিয়। এই প্রজন্মের অনেকের কাছে নতুন হলেও নব্বই দশকে যারা শৈশব পার করেছে তাদের কাছে অন্য রকম এক অনুভূতি। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে মীনা কার্টুনের প্রথম পর্ব সম্প্রচার করা হয়। সেই হিসাবে ৩১ পেরিয়ে ৩২ বছরে পা দিচ্ছে মীনা। দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন সামাজিক পরিবর্তন সাধনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে মীনা নামক এ কার্টুন সিরিজ।

আরও পড়ুন

আপনার কাছের মানুষটি আত্মহত্যার কথা ভাবছে না তো?

৩টি পর্ব দিয়ে শুরু হলেও পরে এ সিরিজটির পর্ব সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৭টি। হিন্দি, বাংলা সহ ২৯টি ভাষায় মীনা তৈরি হয়েছে। মুরগিগুলো গুনে রাখো, বুদ্ধিমতি মীন, মীনা কি স্কুল ছেড়ে দেবে, মীনা ও দুষ্টু ছেলে, মীনার তিনটি ইচ্ছা, বিয়ের বয়স হয়নি, মেয়েদের যত্ন নাও, আমি স্কুল ভালোবাসি, মীনা এখন শহরে বেশ জনপ্রিয়।

Advertisement

কাল্পনিক মীনা হয়ে ওঠে ঘরের মেয়ে। নিজ গ্রামে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ল্যাটট্রিন বানানো, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, মেয়ে শিশুকে স্কুলে পাঠানো এবং মেয়ে ও ছেলে সন্তানের মধ্যে বৈষম্য, বাল্যবিয়ে, যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া এক চরিত্র মীনা। মীনার সঙ্গে এই সিরিজে আছে আরও বেশ কিছু জনপ্রিয় চরিত্র। যেমন দোকানদার, টিয়া পাখি মিঠু, মীনার দুষ্টু বন্ধু দীপু, মীনার দাদি, মোড়ল, রিতা, স্কুলের বড় আপা, ফুফু আম্মাসহ আরও অনেকে।

১৯৯১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরকে জাতিসংঘ কন্যাশিশু দশক হিসেবে ঘোষণা করেছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে শুরুতে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে সম্প্রচারিত হলেও পরে বিশ্বের ২৯টি ভাষায় অনূদিত হয় মীনা সিরিজ। জাতিসংঘ শিশু তহবিল এটি প্রসারের দায়িত্ব নেয়। সে সময় ডেনমার্ক সরকার দক্ষিণ এশিয়াতে অ্যানিমেশন কার্টুন তৈরির জন্য অর্থসহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব দিলে বাংলাদেশ রাজি হয়। মীনা কার্টুন ১৯৯০ সালে ইউনিসেফ বাংলাদেশের যোগাযোগ বিভাগের নিল ম্যাককি ও কোল ডজের নেতৃত্ব যাত্রা শুরু করে।

ইউনিসেফের যোগাযোগ বিভাগের প্রধান কানাডীয় নিল ম্যাককির নির্দেশনায় ইউনিসেফের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ শামসুদ্দিন আহমেদ পরিকল্পনা করেন। এ অঞ্চলের সব দেশের মানুষের কথা বিবেচনা করে মীনা নামটি প্রস্তাব করা হয়। ভারতের মুম্বাইয়ের রামমোহন প্রতিটি চরিত্রের পোশাক কী হবে, তাদের অবয়ব কী হবে, সেগুলো আঁকেন।

মীনা কার্টুনের প্রথম পর্ব ‘মুরগিগুলো গুণে রাখ’ ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যানিমেশন স্টুডিও হানা বারবারায় তৈরি করা হয়। পরে মীনা কার্টুন মুম্বাইয়ের রামমোহন স্টুডিওতে তৈরি হয়। এখন বাংলাদেশেই মীনা কার্টুন তৈরি হয়। মীনা কার্টুন তৈরিতে র্যাচেল কার্নেগি ইউনিসেফের মীনা প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। নুজহাত শাহজাদি ও ভারতের মীরা আঘি প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। কার্টুনের থিম গান ‘আমি বাবা-মায়ের শত আদরের মেয়ে, বড় হই সকলের ভালোবাসা নিয়ে..’ গেয়েছেন বলিউড গায়িকা সুষমা শ্রেষ্ঠ।

Advertisement

দক্ষিণ এশিয় দেশগুলোতে বিভিন্ন সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি এবং শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক একটি অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে ইউনিসেফের সহায়তায় এই কার্টুন ধারাবাহিকটি নির্মিত হয়ে থাকে। যেসব সচেতনতা মীনা কার্টুনের মাধ্যমে তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে তার মধ্যে আছে, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণ ও ব্যবহারে উৎসাহিত করা, মেয়েদের স্কুলে পাঠানো, কমবয়সী মেয়েদের বিয়ে থেকে স্কুলকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, যৌতুক বন্ধ করা, ছেলে-মেয়ে সমান পুষ্টি ও সুযোগ-সুবিধার দাবিদার, প্রয়োজনীয় ও সমঅধিকার পেলে মেয়েরাও অনেক কিছু হতে পারে তা বোঝানো, শহরের বাসায় বাসায় কাজে সাহায্য করে এমন মেয়েদের প্রতি সুবিচার ও তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। প্রতিবছর ২৪ সেপ্টেম্বর মীনা দিবস হিসেবে দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইস্ট-এশিয়ার দেশসমূহে পালন করা হয়।

আরও পড়ুন

জীবনের প্রথম ও শেষ চিঠি টয়লেট পেপার আবিষ্কার হলো যেভাবে

কেএসকে/এমএস