জাতীয়

‘সোনার টুকরা ছোট ভাইটা আজ চিরতরে হারিয়ে গেলো’

মুক্তিকামী দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যাতে কখনোই দাঁড়াতে না হয়, সে ভাবনার ভেতর সব সময় ছিলেন লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জন। স্বৈরাচারের অবৈধ নির্দেশ পালন না করে জনগণের পক্ষেই যে ম্যোরাল সাপোর্ট বজায় রাখতে হবে ওদের, এই ব্যাপারটা খুব ভেতর থেকে অনুধাবন করতেন তিনি।

Advertisement

কক্সবাজারের চকরিয়ায় ডাকাতদের হামলায় তানজিমকে হারিয়ে কথাগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সাইয়েদ আব্দুল্লাহ।

‘আমার এই সোনার টুকরা ছোট ভাইটা আজ চিরতরে হারিয়ে গেলো’ উল্লেখ করে সাইয়েদ আব্দুল্লাহ পাবনা ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী তানজিমকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে তার জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন।

সাইয়েদ আব্দুল্লাহ মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) ফেসবুকে লেখেন, ‘সকালবেলায় উঠেই যে খবরটা পেলাম, তা শুনে অনেকক্ষণ বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কক্সবাজারের চকরিয়ায় যৌথবাহিনীর অভিযান পরিচালনা করার সময় লেফটেন্যান্ট তানজিম ছরোয়ার নির্জন (বিএ-১১৪৫৩) নিহত হয়েছেন।

Advertisement

রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে একটা সোর্সের বরাত দিয়ে অস্ত্রসহ সন্ত্রাসীর খোঁজ পেয়ে আর্মির একটা টিম অভিযানে গিয়েছিল কক্সবাজারের চকরিয়ায়। অস্ত্রধারীদের ঘাঁটি কর্ডন করে রেখেছিল আর্মির টিম, আর্মির ওপর টার্গেট করে গুলি ছুড়তে থাকে মিসক্রিয়েন্টরা। তানজিমের শরীরে গুলি লাগে।

আবার সন্ত্রাসীরা এরপর এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতও করে তানজিমের ওপর। চোখে এবং কাঁধে ব্যাপকভাবে ছুরিকাঘাত করা হয়। গুলি এবং ছুরিকাঘাত উভয়ই তার মৃত্যুর জন্য দায়ী বলে জানা যায় সর্বশেষ খবরে। তবে আর্মির পক্ষ এ ব্যাপারে চূড়ান্ত বিবৃতি দিলে হয়তো পুরো ব্যাপার সম্পর্কে আরও জানা যাবে।

ঘটনা ঘটার পর ইমিডিয়েটলি তাকে ফিল্ড হাসপাতালে নেওয়া হয়, অবস্থা বেগতিক দেখে সিএমএইচে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু নেওয়ার আগেই মারা যায় তানজিম।’

ওকে ডাকতাম ‘লিটল তানজিম’ নামে

তানজিমকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে সাইয়েদ আব্দুল্লাহ লেখেন, ‘কলেজে আমার তিন ব্যাচ জুনিয়র ছিল তানজিম, হাউজমেট ছিল। পাবনা ক্যাডেট কলেজের ৩৬তম ব্যাচের ক্যাডেট ছিল সে। হাউজের জন্য বহু কাজ ছেলেটাকে দিয়ে করিয়েছি। যখন যা কমান্ড করতাম, তড়িঘড়ি করে কাজ সেরে ফেলতো। কত কত স্মৃতি যে আছে ছেলেটার সাথে, তা বলে শেষ করা যাবে না। কলেজে যেই তিন বছর পেয়েছি, দৈহিক গড়নে ছেলেটা ছিল খুবই পিচ্চি। আমি ওকে ডাকতাম ‘লিটল তানজিম’ নামে। ওদের ব্যাচের যে কয়েকজন জুনিয়রের সাথে কলেজ থেকে বের হওয়ার পরও খুব ভালো যোগাযোগ ছিল, তার ভেতর লিটল ছিল সবচেয়ে ক্লোজ।’

Advertisement

‘মাঝে মাঝেই ফোন দিয়ে, মেসেজ দিয়ে কথাবার্তা বলতো’ উল্লেখ করে সাইয়েদ আব্দুল্লাহ লেখেন, ‘এমনকি এবারের আন্দোলন চলার সময়ও ছেলেটা একদম প্রথম থেকেই যোগাযোগ রাখতো, আমার কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, সেটা নিয়ে খুব কনসার্নড ছিল ছেলেটা, ইউনিফর্ম পরে মুক্তিকামী দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যাতে ওর কখনোই দাঁড়াতে না হয়, এটা ওর ভাবনার ভেতর সবসময় ছিল। স্বৈরাচারের অবৈধ নির্দেশ পালন না করে জনগণের পক্ষেই যে ম্যোরাল সাপোর্ট বজায় রাখতে হবে ওদের, এই ব্যাপারটা ছেলেটা খুব ভেতর থেকে অনুধাবন করতো।’

‘সেদিনও ফোনে কত কথা বললো। ওর পরিচিত এক ফ্যামিলি পারসনের ইস্যু নিয়ে। হঠাৎ করেই ওর আইডিতে ঢুকে দেখি আমাকে বার্থডে উইশও করে রেখেছিল, ব্যস্ততার কারণে সেই মেসেজটা পর্যন্ত দেখতে পারিনি। ওর মেসেজটার উত্তরটা আর কোনোদিন দেওয়া হবে না! কোনোদিনই না!’

সবার শেষে সাইয়েদ আব্দুল্লাহ লেখেন, ‘আমার এই সোনার টুকরা ছোট ভাইটা আজ চিরতরে হারিয়ে গেলো। হে আল্লাহ, তুমি আমার লিটলকে শহীদ হিসেবে কবুল করে নিও। হে আল্লাহ, তুমি আমার লিটলকে জান্নাত নসিব করো।’

অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা তোকে এভাবে চিরতরে শেষ করে দিলো!

সাইয়েদ আব্দুল্লাহ আরেকটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘এত এত স্মৃতির পসরা রেখে এভাবেই তোকে চলে যেতে হলো চিরতরে! অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা তোকে এভাবে চিরতরে শেষ করে দিলো! সেদিনও কত কথা হলো, ওইটাই যে শেষ কথা হবে, সেটা কে জানতো! তানজিম, তুই যে আর নাই, সেটা আমি বিশ্বাস করতে চাই না। আমার স্মৃতিতে সারাটাজীবন তুই বেঁচে থাকবি ওই লিটল তানজিম হিসেবেই।’

সবশেষ স্ট্যাটাসে সাইয়েদ আব্দুল্লাহ নিহত এই সেনা কর্মকর্তার জানাজা নিয়েও কথা বলেন।

তিনি লেখেন, ‘নিহত লেফটেন্যান্ট তানজিম এর জানাজা ঢাকায় কেন করা হচ্ছে না? রামু থেকে কেন তাকে সরাসরি নিজ জেলা টাঙ্গাইলে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান চলছে? ঢাকায় তার একটা কেন্দ্রীয় জানাজা হওয়া উচিত ছিল, অবশ্যই উচিত! ঢাকায় তার জানাজা হলে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারতো। আমাদের সেনাবাহিনীর জীবন এত তুচ্ছ না। সবাই মিলে তাদের প্রটেকশনের জন্য একতাবদ্ধ হওয়ার দরকার আছে। ঢাকায় তানজিমের জানাজা হলে, সেটা ফোকাসে আসতে পারতো বেশি।

আমার দাবি থাকবে সরাসরি টাঙ্গাইলে পাঠিয়ে দিয়ে দাফন করার আগে, ঢাকায় তার একটা জানাজার আয়োজন করা দরকার সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে।’

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমানের ছাগলকাণ্ড সামনে এনেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সাইয়েদ আব্দুল্লাহ। এর আগে, ‘রাফসান দ্য ছোট ভাই’ নামক একজন ইউটিউবারের পরিবারের ঋণখেলাপির বিষয় জনসম্মুখে এনে আলোচনায় আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক এই শিক্ষার্থী। সেই থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন পরিচিত মুখ তিনি।

লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জনের মৃত্যু প্রসঙ্গে মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২৩ সেপ্টেম্বর দিনগত রাত ৩টার দিকে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামে ডাকাতির খবর পাওয়া যায়। এসময় চকরিয়া আর্মি ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।

আরও পড়ুন

ডাকাত দলকে তাড়া করতে গিয়ে ছুরিকাঘাতে তরুণ সেনা কর্মকর্তা নিহত

আনুমানিক রাত ৪টার দিকে মাইজপাড়া গ্রামে অভিযান পরিচালনা করার সময় ৭-৮ সদস্যের একটি ডাকাত দল সেনা টহল দলের উপস্থিতি টের পেয়ে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। এ সময় লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জন (২৩) ডাকাত দলের কয়েকজনকে তাড়া করেন। ডাকাত দলের সদস্যরা লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জনের ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করলে গুরুতর আহত হন তিনি। তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার করে মালুমঘাট মেমোরিয়াল হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

আইএসপিআর আরও জানায়, লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জন টাঙ্গাইল জেলার একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মেধাবী এই তরুণ সেনা কর্মকর্তা পাবনা ক্যাডেট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ৮২তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের সঙ্গে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে ২০২২ সালের ৮ জুন আর্মি সার্ভিস কোরে (এএসসি) কমিশন লাভ করেন।

আইএসপিআর জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে তিনজন ডাকাতকে আটক করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে একটি বন্দুক ও ৬ রাউন্ড গোলাবারুদ। এছাড়া ডাকাত সন্দেহে আরও তিনজনকে আটক করা হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, এই তরুণ সেনা কর্মকর্তার আত্মত্যাগ সেনাবাহিনী গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে এবং সেই সঙ্গে তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে।

এসএনআর/এমএমএআর/এমএস