স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পশু জবাই করতে পুরান ঢাকার কাপ্তান বাজার ও হাজারীবাগে আলাদা দুটি আধুনিক পশু জবাইখানা নির্মাণ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। দুই জবাইখানা নির্মাণে ব্যয় প্রায় দেড়শ কোটি টাকা। হাজারীবাগেরটা নির্মাণের পাঁচ বছরেও চালু হয়নি। কাপ্তান বাজারেরটাও পড়ে রয়েছে কয়েক মাস। ফলে সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী।
Advertisement
ঢাকায় কোনো জবাইখানা চালু না থাকায় যত্রতত্র পশু জবাই করছেন মাংস ব্যবসায়ীরা। এসব পশু জবাইয়ের আগেও কোনো ধরনের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হচ্ছে না। ফলে রোগাক্রান্ত পশুও জবাই হচ্ছে অহরহ। এমন মাংস কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। আর অসুস্থ পশুর মাংস খেয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে নগরবাসীর।
নগরবাসী ও নগর পরিকল্পনাবিদরা জানান, ওই দুটি পশু জবাইখানা নির্মাণের আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করেনি ডিএসসিসি। ফলে বিপুল ব্যয়ে নির্মিত আধুনিক দুটি পশু জবাইখানার সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী।
ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টদের দাবি, ওই দুটি আধুনিক জবাইখানা পরিচালনার জন্য এখন পর্যন্ত চারবার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়নি। এছাড়া অনানুষ্ঠানিকভাবে জবাইখানাগুলো পরিচালনার জন্যও কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আবার নিজস্ব জনবল দিয়ে এসব জবাইখানা পরিচালনার সক্ষমতা ও কারিগরি দক্ষতাও নেই ডিএসসিসির। এখন জবাইখানাগুলো নিয়ে কী করা হবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় সংস্থাটি।
Advertisement
হাজারীবাগ জবাইখানা পরিচালনায় বারবার বিজ্ঞপ্তি দিয়েও পরিচালনা প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাচ্ছে না। আর কাপ্তান বাজারের নির্মাণকাজ শেষ হলেও দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি চলছে।- ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মুনিরুজ্জামান
জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান সম্প্রতি জাগো নিউজকে বলেন, ‘যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে এটার কার্যকারিতা কতটুকু, তা দেখতে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হয়। কিন্তু হাজারীবাগ ও কাপ্তান বাজার পশু জবাইখানার ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। যদি সম্ভাব্যতা যাচাই করা হতো, এত বড় প্রকল্প এভাবে পড়ে থাকতো না বা বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াতো না। এ ব্যর্থতার দায় করপোরেশনকেই নিতে হবে।’
আরও পড়ুনযত্রতত্র পশু জবাইয়ে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিপশু জবাইয়ের যে ভুলে নষ্ট হতে পারে কোরবানির সওয়াব অসুস্থ মহিষ রাতে জবাই, দিনে গরুর মাংস হিসেবে বিক্রিডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে নির্মাণকাজ শুরুর পর হাজারীবাগের গজমহলে পশু জবাইখানা তৈরিতে ৮১ কোটি ১৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সেখানে ঘণ্টায় ৩০টি গরু ও ৬০টি ছাগল জবাই করা যাবে। জবাইখানা চালু রাখা যাবে প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা। পরে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও কিছু যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়। আধুনিক এ পশু জবাইখানার নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই ২০১৯ সালে সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন এর উদ্বোধন করেন। কিন্তু গত পাঁচ বছরে সেখানে একটি পশুও জবাই হয়নি।
২০১৮ সালে হাজারীবাগের পাশাপাশি গুলিস্তানের কাপ্তান বাজারে আরেকটি আধুনিক পশু জবাইখানার নির্মাণকাজ শুরু হয়। কিন্তু ঠিকাদারের গাফিলতিতে দীর্ঘদিন এর কাজ বন্ধ থাকে। পরে গত মে মাসে জবাইখানাটির কাজ শেষ হয়। এই জবাইখানা ভবন নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি কিনতে প্রায় ৫২ কোটি টাকা খরচ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি।
Advertisement
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, পাঁচতলাবিশিষ্ট হাজারীবাগ পশু জবাইখানার প্রধান ফটকে তালা ঝুলছে। ভিতরে জমছে ধুলার আস্তরণ। এটি দেখভালের জন্য ফটকের ভেতরে বা বাইরে কোনো নিরাপত্তাকর্মী বা অন্য কেউ নেই। কাপ্তান বাজার পশু জবাইখানারও একই চিত্র।
কাপ্তান বাজার আধুনিক পশু জবাইখানার দক্ষিণপাশে মাহিন মাংস বিতান। এ দোকানের সামনে গরু, ছাগলের মাংস ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দোকানের সামনে কয়েকটি ছাগলও বেঁধে রাখা। চাহিদা থাকলে এই ছাগলগুলোও দোকানের সামনে ড্রেনের পাশেই জবাই করা হবে বলে জানান দোকানি ফারুক হোসেন।
তিনি বলেন, ‘এখন তো পশু জবাই করার নির্দিষ্ট জায়গা নেই। ঢাকার সব ব্যবসায়ী নিজ দোকানের সামনে পশু জবাই করেন। জবাই শেষে রক্ত-বর্জ্য নিজেরাই পরিষ্কার করেন। তবে পশু জবাইখানাটি চালু হলে সব ব্যবসায়ীর জন্যই উপকার হতো।’
জানতে চাইলে কাপ্তান বাজার ও হাজারীবাগে জবাইখানা নির্মাণ কাজের প্রকল্পের পরিচালক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকের জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত জুনে কাপ্তান বাজার জবাইখানার সব যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করা হয়েছে। সব কিছুই ঠিকমতো কাজ করছে। একইভাবে হাজারীবাগের সব যন্ত্রপাতি সচল। কিন্তু পরিচালনা প্রতিষ্ঠান না পাওয়ায় এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না।’
জবাইখানা পরিচালনায় প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে না ডিএসসিসিডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ সূত্র জানায়, হাজারীবাগ জবাইখানাটি পরিচালনার জন্য চারবার দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিন বছরের জন্য জবাইখানা পরিচালনা করতে সিটি করপোরেশনকে ৮ কোটি ৫৬ লাখ ১১ হাজার ২১০ টাকা দিতে হবে। এমন তথ্য উল্লেখ করে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রথম বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও কেউ দরপত্র জমা দেয়নি। পরে ইজারামূল্য কমিয়ে ৬ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৩১৯ টাকা নির্ধারণ করে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে আবার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এ দফায়ও কেউ দরপত্র জমা দেয়নি। একইভাবে আরও দুবার দরপত্র আহ্বান করা হলেও সাড়া দেয়নি কেউ। আর কাপ্তান বাজার জবাইখানা পরিচালনায় ইজারাদার চেয়ে দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি চলছে।
কাপ্তান বাজার ও হাজারীবাগের আধুনিক জবাইখানায় বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পশু জবাই করার সব ব্যবস্থা রয়েছে। এখন ঢাকার যেসব স্থানে পশু জবাই হচ্ছে, ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের ভেটেরিনারি কর্মকর্তারা যতটা সম্ভব তা তদারকি করছেন।- ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সম্পত্তি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, এখন ঢাকার মাংস ব্যবসায়ীরা যে যার মতো করে নিজ দোকানের সামনে পশু জবাই করেন। তাই জবাইখানাগুলো চালু হলে সেখানে আদৌ কেউ যাবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাই কাপ্তান বাজার ও হাজারীবাগ জবাইখানা পরিচানায় কোনো প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ইজারামূল্য কমিয়ে বারবার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হচ্ছে।
ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মুনিরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাজারীবাগ জবাইখানা পরিচালনায় বারবার বিজ্ঞপ্তি দিয়েও পরিচালনা প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাচ্ছে না। আর কাপ্তান বাজারের নির্মাণকাজ শেষ হলেও দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি চলছে।’
যা বলছে ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগডিএসসিসি এলাকায় পশু জবাইয়ের আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করে সংস্থাটির স্বাস্থ্য বিভাগ। বিভাগটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাপ্তান বাজার ও হাজারীবাগের আধুনিক জবাইখানায় বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পশু জবাই করার সব ব্যবস্থা রয়েছে। এখন ঢাকার যেসব স্থানে পশু জবাই হচ্ছে, ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের ভেটেরিনারি কর্মকর্তারা যতটা সম্ভব তা তদারকি করছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা ছিল অঞ্চলভিত্তিক জবাইখানা নির্মাণ করা। যাতে মাংস ব্যবসায়ীরা সহজেই জবাইখানার সেবা পেতে পারেন। এখন যে দুটি জবাইখানা নির্মাণ করা হয়েছে, তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। তারপরও এ দুটি চালু হলে ভবিষ্যতে জবাইখানা আরও বাড়ানো হবে। আর মাংস ব্যবসায়ীরা যাতে জবাইখানার বাইরে পশু জবাই দিতে না পারেন, তা নিশ্চিত করা হবে।’
আধুনিক পদ্ধতি হবে জবাই ও মাংস প্রসেসডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, ডিএসসিসির পরিকল্পনা অনুযায়ী এই দুটি জবাইখানায় পশু ঢোকানোর পর প্রথমে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করবেন ভেটেরিনারি কর্মকর্তা। স্বাস্থ্যপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে গরুর মালিককে টোকেন ধরিয়ে দেওয়া হবে। তারপর যন্ত্রের সাহায্যে পশু জবাই করবে পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান। পরে মাংস কেটে পশু মালিককে তা বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এজন্য পশুপ্রতি সিটি করপোরেশন বা পরিচালনা প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট ফি দিতে হবে। তবে সেই ফি এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এ দুটি জবাইখানা চালু হওয়ার পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে, মাংস ব্যবসায়ীদের জবাইখানামুখী করা। কারণ, যেখানে এখন একটি বড় গরু এক ঘণ্টার মধ্যে জবাইসহ মাংস কাটতে পারেন ব্যবসায়ীরা, সেখানে জবাইখানায় যাওয়া, সিরিয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা, জবাইয়ের জন্য ফি দিতে হবে।’
এমএমএ/এএসএ/জেআইএম