সবাই দেখলো জানলো, পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানিদের ‘বাংলাওয়াশ’ করার ১৫দিন পর ভারতের চেন্নাইতে রোহিত শর্মার দলের সাথে পাত্তাই পায়নি বাংলাদেশ। হারলো ২৮০ রানের বড় ব্যবধানে।
Advertisement
শেষ পর্যন্ত শুধু বড় ব্যবধানে হারাই নয়, পুরো ম্যাচের প্রথম দিন দুই সেশন ছাড়া বাকি তিনদিন একটি সেশনেও বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। একটি ইনিংস ও বিচ্ছিন্ন কোনো বোলিং স্পেলও আর চোখে পড়েনি। বরং যত সময় গড়িয়েছে, বাংলাদেশের বোলার ও ব্যাটারদের পারফরমেন্স তত অনুজ্জ্বল হয়েছে। কেউ ব্যাট ও বল হাতে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি।
১৯ সেপ্টেম্বর প্রথম সেশনে হাসান মাহমুদ আর ২০ সেপ্টেম্বর সকালে তাসকিন আহমেদ দুটি বেশ ভাল স্পেল উপহার দিয়েছেন। হাসান মাহমুদের ধারালো বোলিংয়েই ভারত ১৪৪ রানে ৬ উইকেট হারিয়েছিল আর পরের দিন সকালে তাসকিনের বোলিংয়েই ৩৭৬ রানের মধ্যে শেষ ৪ উইকেট খুইয়ে বসে রোহিত শর্মার দল।
ওই দুটি বোলিং পারফরমেন্স ছাড়া গত চারদিনে বাংলাদেশের কোন পারফরমার একটি সেশনের জন্যও ভারতীয়দের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। রাওয়ালপিন্ডিতে ২৬ রানে ৬ উইকেট পতনের পরও ১৬৫ রানের বড় সড় জুটি গড়ে ফেলা লিটন ও মিরাজ চেন্নাইতে ব্যাট হাতে এতটুকু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি।
Advertisement
যে ওপেনার সাদমান শাহিন শাহ আফ্রিদি, নাসিম শাহর বিপক্ষে প্রথম টেস্টে অনেকক্ষণ ব্যাট করে ৯০-এর ঘরে (৯৩) পা রেখেছেন, সেই সাদমান চেন্নাইতে দুই ইনিংসে করেছেন মোটে (২ ও ৩৩) ৩৫। মুশফিকুর রহিম পাকিস্তানের সাথে ব্যাট হাতে নেমেই রানের ফুলঝুরি ছুটিয়েছেন। প্রয়োজনে, বিপদে একদিক আগলে প্রায় ডাবল সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় গিয়ে আউট হয়েছেন। মিরাজ ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অলরাউন্ড পারফরমেন্স উপহার দিয়ে একজোড়া বিগ ফিফটি (৭৭ ও ৭৮ রান) ৯ উইকে শিকারী, এছাড়া লিটন দাসও দুই টেস্টেই একবার পঞ্চাশ ও একবার শতকসহ ১৩৮ রানের বড় ইনিংস উপহার দিয়েছেন।
মুমিনুল হকের ব্যাট থেকেও পাকিস্তানের সাথে প্রথম টেস্টে পঞ্চাশ এসেছিল। তারা সবাই চুপসে গেলেন। কিছুই করতে পারলেন না। তা আসলে বিশ্বাস করা কঠিন। মানা গেল, পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের বোলিং ঢের সমৃদ্ধ। জসপ্রিত বুমরাহ, মোহাম্মদ সিরাজ, আকাশদিপ সিংয়ের পেস বোলিং লাইনআপ অনেক ধারালো, আর রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও রবিন্দ্র জাদেজার গড়া স্পিন বোলিং বিশ্বমানের।
তাদের অভিজ্ঞতা, স্কিল, মেধা, কার্যকরিতা প্রমাণিত। পরিক্ষিত। তাই তাদের বিপক্ষে ভাল খেলা কঠিন। তারপরও পাকিস্তানের বিপক্ষে টাইগারদের ব্যাটিং ও বোলিং পারফরমেন্সের গ্রাফ যতটা ওপরে ছিল, সাদমান, মুমিনুল, মুশফিক, লিটন ও মিরাজের মধ্যে মাথা উচুঁ করে খেলার যে ইচ্ছে, সাহস, প্রত্যয় ও উদ্যম দেখা গিয়েছিল, তার ছিটেফোটাও দেখা গেল না চেন্নাইতে। কেমন যেন আড়ষ্টতা, মানসিক দুর্বলতায় আচ্ছন্ন সবাই।
মানসিক অবস্থা, অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশন আর পারফরমেন্সের এত ফারাক কেন? বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের পারফরমেন্স এত অনুজ্জ্বল, নিষ্প্রভ এবং খারাপ হলো কেন? চেন্নাই টেস্ট মাঠে বসে দেখা বিকেএসপির সাবেক প্রধান টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার নাজমুল আবেদিন ফাহিম আজ বিকেলে জাগোনিউজের সাথে মুঠোফোন আলাপে তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছেন।
Advertisement
ফাহিমের অনুভব, ‘সব বিভাগেই ভারতীয়রা বাংলাদেশের চেয়ে শ্রেয় এবং ঢের এগিয়ে। মেধা, মনন, প্রজ্ঞা, স্কিল, টেকনিক, অ্যাপ্রোচ, অ্যাপ্লিকেশন, মানসিক দৃঢ়তা, পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা- সব কিছুতেই আমাদের ক্রিকেটাররা ভারতীয়দের চেয়ে পিছিয়ে।’
কিন্তু সেটাই ভারতের কাছে নাকাল হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। আসল কারণ ভিন্ন। ফাহিমের উপলব্ধি হলো, শুধু স্কিল আর অভিজ্ঞতায় এগিয়ে থাকার কারণেই যে ভারতীয়রা ভাল খেলে বড় জয় পেয়েছে, তা নয়। ভারতীয়দের সাথে তাদের মাটিতে ভাল খেলা এবং নিজেদের স্বাভাবিক পারফরমেন্স করা আসলে অনেক কঠিন।
কারণ, মাঠে ভারতীয়রা মনের দিক থেকে অনেক টাফ থাকে। প্রতিপক্ষের ওপর শুধু বল ও ব্যাটে কর্তৃত্ব ফলাতে চায় না। সব সময় প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে চাপে রাখতে চায়। শারীরিক অভিব্যক্তি, মাঠে শরীরি ভাষা, কথা-বার্তা, আচরণ দিয়ে পুরো সময় মাঠে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে রাখে যাতে প্রতিপক্ষ মানসিকভাবে চাপে থাকে এবং দুর্বল হয়ে পড়ে।
ফাহিম আরও বলেন, ‘ভারতীয়রা কখনোই চায় না প্রতিপক্ষের বোলার ও ব্যাটাররা তাদের ওপর ছড়ি ঘোরাক। আপনাকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিতেই চাইবে না। মানসিকভাবেও ক্রমাগত চাপে রাখবে। যে চাপ সহ্য করে স্বচ্ছন্দে ও স্বাভাবিক খেলা সত্যিই কঠিন।’
ফাহিম যোগ করেন, ‘শরীরি ভাষা, মাঠে আচার-আচরণ, কথা-বার্তা ও প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে আক্রমণ করা, দুর্বল করে রাখার কাজটিও খুব ভাল জানে ভারতীয়রা। সেই চাপ সহ্য করে নিজেকে মেলে ধরা খুব কঠিন। বিশেষ করে ব্যাটিংয়ের সময় ভারতীয় বোলার, ফিল্ডারদের চোখে মুখের ভাষা থাকে খুব আক্রমণাত্মক। আপনি কিছু ভাল শট খেললে তারা ভড়কে না গিয়ে চোখে চোখ রেখে তাকায়, নিজেদের মাঝে এমন সব কথা-বার্তা বলতে থাকে, যা আপনার কনফিডেন্স লেভেলটাকে দেয় কমিয়ে। আর ক্রমাগত এরকম অবস্থায় টানা উইকেটে থাকা ও ভাল খেলা কঠিন।’
‘একজন কোচ হিসেবে চেন্নাই টেস্ট স্ব-শরীরে মাঠে বসে দেখে আমার সেটাই মনে হয়েছে। ওই আক্রমণাত্মক আর টাফ মেন্টালিটি এবং মুখায়ব, কথা-বার্তা সহ্য করে ভাল খেলা অনেক কঠিন। আর তাই আমাদের সাদমান, জাকির, লিটন, সাকিব ও মুশফিকরা সেট হয়েও ইনিংসকে লম্বা করতে পারেনি। ওই মানসিক চাপ থেকে বেরিয়ে কেউ কেউ অতি আক্রমণাত্মক হতে চেয়েছে এবং মারতে গিয়ে উইকেট দিয়ে এসেছে। সেটাও ভারতীয়দের কৌশলের একটা অংশ। তারা প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের এমন অবস্থায় ফেলে দেয়, যেখান থেকে শুধু টেকনিক, স্কিল দিয়েই বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। মেন্টাল টাফনেস, মানসিক দৃঢ়তা, স্থিতিশীল মানসিকতাও খুব জরুরি।’
এআরবি/আইএইচএস