একুশে বইমেলা

স্মৃতিতে হুমায়ূন আহমেদ: অভিনেতার চোখে নির্মাতা

লিমা সুলতানা

Advertisement

অভিনেতা ফারুক আহমেদ অনেকদিন ধরে ভাবছিলেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে কিছু লিখবেন। কিন্তু সাহস পাচ্ছিলেন না। তিনি ভাবেন, এত বড় মাপের একজন লেখক। তাঁকে নিয়ে ফারুক আহমেদের মতো অনভিজ্ঞ লেখকের লেখা কি ঠিক হবে? কী লিখতে কী লিখে ফেলবেন। পাছে মানুষ হাসাহাসি করে। উল্টা-পাল্টা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনের মধ্যে কোথা থেকে যেন সাহস পেলেন। যা থাকে কপালে। তিনি লিখবেন। কে কী ভাবলেন, তাতে তার কী?

এরপর ফারুক আহমেদ লেখা শুরু করলেন। বইয়ের নাম দিলেন ‘স্মৃতিতে হুমায়ূন আহমেদ’। ফারুকের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের দীর্ঘদিনের স্মৃতি। সেইসব স্মৃতি নিয়ে লেখা তার প্রথম বই। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে স্মৃতি ছাড়াও ফারুকের দেখা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, ঢাকা থিয়েটারের কথা, মায়ের স্মৃতি ইত্যাদি বিষয়ে বেশকিছু লেখা বইটিতে যুক্ত করেছেন। আমি নিশ্চিত, মনোযোগ দিয়ে পড়লে বইটি পাঠকের ভালো লাগবে।

বইটিতে মোট ২২টি স্মৃতির গল্প রয়েছে। যেমন- প্রথম দেখার স্মৃতি, প্রথম নাটক অচিনবৃক্ষ, উড়ে যায় তৈয়বপক্ষি, পাঞ্জাবি সমাচার, ক্রিকেট প্রেমিক হুমায়ূন আহমেদ, সমুদ্র এবং সমুদ্রবিলাস, একজন অন্যরকম ভক্ত ডাক্তার আশরাফ, নুহাশপল্লীর ভূত রহস্য, হুমায়ূন ভাইয়ের রসিকতা, একজন সহজ মানুষ, অনাহুত আমি, বৃষ্টিবিলাসী হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কুতুবপুর যাত্রা, একজন ক্ষুদে ভক্তের কথা, শেষ নাটক ‘পিপীলিকা’, শেষ সাক্ষাৎকার, অভিনয়ের শুরু, মুক্তিযুদ্ধের কথা, যুদ্ধ এবং যাযাবর জীবন, আমি যুদ্ধে যাব, যখন আমি আম বিক্রেতা, ঢাকায় প্রত্যাবর্তন, যেদিন স্বাধীন হলো দেশ।

Advertisement

১৯৭২ সালে হুমায়ূন আহমেদের সাথে প্রথম দেখা হয়। লেখক তখন মোহাম্মদপুর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির ছাত্র। লেখকের সাথে ভর্তি হন আহসান হাবীব নামে একটি ছেলে। তার ডাকনাম শাহীন। প্রথমদিকে খুব বেশি কথা না হলেও একটা সময় তারা খুব ভালো বন্ধু হন। লেখক জানতে পারেন তার বন্ধু শাহীন তারই পছন্দের লেখকের ছোট ভাই। আর বন্ধু শাহীনের সূত্র ধরে প্রথম হুমায়ূন আহমেদের সাথে দেখা হয়। (প্রথম দেখার স্মৃতি)

হুমায়ূন আহমেদের একটি নাটক ছিল। তার নাম ছিল ‘উড়ে যায় বকপক্ষি’। সে নাটকে লেখকের চরিত্রের নাম তৈয়ব। আর তার চরিত্র ছিল অল্প সময়ের। পরে বিশেষ কারণে তার চরিত্রের সময় এত বেশি হয় যে, তা দেখে মেহের আফরোজ শাওন হুমায়ূন আহমেদকে বলেন, নাটকের নাম উড়ে যায় বকপক্ষি না রেখে উড়ে যায় তৈয়বপক্ষি রাখলে ভালো হতো।

লেখকের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের এত ভালো সম্পর্ক ছিল যে, একবার ঈদে লেখক সপরিবারে দেশের বাইরে ছুটি কাটানো জন্য যান। আর তাতেই হুমায়ূন আহমেদকে প্রতিবছরের মতো পাঞ্জাবি দিতে পারেননি। তাতে লেখকের ওপরে ভীষণ অভিমান করেন। পরের বছরে যখন লেখক আবার হুমায়ূন আহমেদের বাসায় যান এবং পাঞ্জাবি দেন। তিনি একদম বাচ্চাদের মতো খুশি হন।

আরও পড়ুনআল মাহমুদের সোনালি কাবিন: সৃষ্টিতে বিস্ময়আশার ছলনে ভুলি: মাইকেল মধুসূদনের জীবন

একবার নাটকের শুটিংয়ের কাজে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল লেখকের। একদিন সকাল বেলা। নাস্তা করা শেষ। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘আজ আমরা শুটিং করবো না। শুটিং করবো না কারণ আজ বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা। আমরা ক্রিকেট খেলা দেখবো।’ ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘শাহীন ভাই দীর্ঘদিন যাবত সাফাউজান টাউনে থাকেন। তার বাসায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। তিনি বললেন, দুইশ কিলোমিটার দূরে জুরিখ শহর। সেখানে গেলে টেলিভিশনে খেলা দেখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। হুমায়ূন আহমেদ সাথে সাথে বললেন, চল, জুরিখ যাব। আমরা সবাই হইহই করে উঠলাম, জুরিখ যাব, জুরিখ যাব।

Advertisement

হুমায়ূন আহমেদ সেন্টমার্টিনে জমি কেনেন। সেখানে একটি সুন্দর বাড়ি নির্মাণ করলেন, নাম সমুদ্রবিলাস। হুমায়ূন আহমেদের শখ হয়েছে তিনি কোনো হোটেল-রেস্টুরেন্টে নয়, নিজের বিছানায় শুয়ে সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বেন। শুধু নিজের ইচ্ছা পূরণের জন্য হুমায়ূন আহমেদ তার এই সুমদ্রবিলাস তৈরি করেন।

হুমায়ূন আহমেদ নিজে ভূতে বিশ্বাস না করলেও নুহাশপল্লীতে যখন নতুন কেউ আসতেন; তখন সে ভূতে বিশ্বাস করুন আর না করুন ভূতের গল্প শুনিয়ে তাকে ভয় পাওয়াতেন। একদিন হুমায়ূন আহমেদের ডাকে লেখক তার কাছে যান। কাজ শেষ করতে দুপুরের খাওয়ার সময় হলে হুমায়ূন আহমেদ লেখককে ডাকলেন, ‘ফারুক, খেতে আসো।’ লেখক বলেন, ‘ভাই, আমি খেয়ে এসেছি।’কিন্তু এই খাওয়া যে সকালের নাস্তা করা তা বলেননি। তবে মিথ্যাও বলেননি। কারণ লেখক সকালে তো নাস্তা করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ তাকে ছাড়লেন না। জোর করে খেতে বসালেন। লেখক ক্ষুধার্ত ছিলেন, দুপুরে খাননি। খাবার পেয়ে গোগ্রাসে খেতে লাগলেন। হুমায়ূন আহমেদ তখন লেখকের খাওয়া দেখে বললেন, ‘ফারুকের খাওয়া দেখো, সে নাকি খেয়ে এসেছে! তার পরেও খাওয়া থামছে না। না খেয়ে এলে বোধ হয় আমাদের সকলের খাবার একাই খেয়ে ফেলতো!’ হুমায়ূন আহমেদের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলেন।

১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী যখন আত্মসমর্পণ করে; তখন লেখক গ্রামে। ঢাকায় চলছে বিজয়োল্লাস। রেডিওতে বার বার আত্মসমর্পণের খবর প্রচার হচ্ছে। তারপরও গ্রামের মানুষ চুপচাপ। কেউ কোনো আনন্দ করার সাহস পাচ্ছে না। বিকেলবেলা লেখকের সামনের গ্রামে আওয়ামী লীগের এক নেতার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছে। লেখক আর তার ভাতিজা বুলবুল বাড়ির সামনের সরিষা ক্ষেতের আইল ধরে দৌঁড়ে সেই নেতার বাড়িতে গেলেন। দেখেন শ’খানেক মুক্তিযোদ্ধা। সবার হাতে রাইফেল। তারা আকাশের দিকে রাইফেল তাক করে ফাঁকা গুলি ছুড়ে উল্লাস করছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা বাঁশের মাথায় বাংলাদেশের বিশাল পতাকা বেঁধে বাড়ির উঠানে টাঙিয়ে দিলেন। বাতাসে পতপত করে উড়তে লাগল পতাকা। দেশ স্বাধীন। সারাদেশ মেতে উঠলো উল্লাসে।

এমনই অনেক স্মৃতিময় গল্প রয়েছে বইটিতে। পড়ে মনে হলো, লেখকের গল্প বলার ধরন খুব সাবলীল। পাঠককে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছেন। আকৃষ্ট করতে পেরেছেন তার গল্প দিয়ে। এক বসাতে শেষ করার মতো একটি বই। বইটি পড়ে নিঃসন্দেহে পাঠক আশাহত হবেন না। তবে খুব দ্রুত বইটি পড়া শেষ হয়ে যাবে। তাই মনে আক্ষেপ থাকতে পারে, আরও কিছু সময় যদি পড়তে পারতাম! যদি আরও কিছু সময় গল্পের ঘোরে থাকতে পারতাম!

লেখক এত সুন্দর-সাবলীল ভাবে প্রতিটি গল্প উপস্থাপন করেছেন, তাতে যে কেউই গল্পের সঙ্গে মিশে যেতে বাধ্য। বইটি পড়ে মনে হলো, লেখক তার লেখনী দিয়ে পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারেন। খুব ভালো লেগেছে বইটি। চাইলে আপনিও পড়তে পারেন ‘স্মৃতিতে হুমায়ুন আহমেদ’। আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি।

বইয়ের নাম: স্মৃতিতে হুমায়ূন আহমেদলেখক: ফারুক আহমেদপ্রচ্ছদ: আইয়ুব আল আমিনপ্রকাশনী: কিংবদন্তী পাবলিকেশনপ্রকাশকাল: বইমেলা ২০২৩মূল্য: ২৫০ টাকা।

এসইউ/জেআইএম