স্বাস্থ্য

স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে সক্রিয় স্বাচিপপন্থিরা!

চিকিৎসা খাতে অচলাবস্থা যেন কাটছেই না। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে স্বাস্থ্য খাতের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ করা হয়। সব প্রতিষ্ঠানের মূল পদে দলীয় সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতাকর্মীদের বাইরে পদায়ন দেওয়া হয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে।

Advertisement

অভিযোগ উঠেছে, সম্প্রতি চিকিৎসকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চিকিৎসকদের সংগঠন বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে সক্রিয় হয়েছেন স্বাচিপ অনুসারী চিকিৎসকরা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে নেওয়া ছবি-সংগৃহীত ছবি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নামে-বেনামে কিংবা চিকিৎসকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যানারে সক্রিয় স্বাচিপপন্থি চিকিৎসক নেতাকর্মীরা। যাদের ফ্যাসিবাদের দালাল বলছেন সাধারণ চিকিৎসকরা।

Advertisement

নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন চিকিৎসক জানান, দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছেন এসব চিকিৎসক। সাধারণ ঘটনা কেন্দ্র করে স্বাস্থ্যখাতে চিকিৎসা শাটডাউন ঘোষণা করতেও বিভিন্ন গ্রুপে সক্রিয় তারা।

স্বাস্থ্য ক্যাডারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন চিকিৎসক জানান, স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক থেকে শুরু করে সদস্য সচিবসহ একাধিক সদস্য স্বাচিপ অনুসারী। যাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে। এখন তারা ভিন্ন ব্যানারে চিকিৎসা খাতে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে। গ্রুপে তাদের নেতারা সামান্য ইস্যুতেই হট্টগোল করে শৃঙ্খলা নষ্টের চেষ্টা করছে। তারা সাধারণ চিকিৎসকদের বোঝাতে চান আমরা তো চিকিৎসকদের জন্য আন্দোলন করছি। তবে এর ভেতরে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে মরিয়া।

সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, সংগঠনটির আহ্বায়ক ডা. মোহাম্মদ নেয়ামত হোসেন আওয়ামী লীগের সভায় নেতাদের সঙ্গে অতিথির আসনে বসে খাওয়া-দাওয়া ও খোশগল্প করছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। সরকারিভাবে তিনি দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিওএনটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। তবে সেখানে তিনি খুব কমই যেতেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে নেওয়া ছবি-সংগৃহীত ছবি

Advertisement

সদস্য সচিব উম্মে তানিয়া নাসরিন ২৮তম বিসিএসের একজন কর্মকর্তা। ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি নিজেই বলেন, ‘গুটিকয়েক মানুষদের মধ্যে একজন-যার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কঠিন সময়ের তৃণমূল পর্যায়ের একজন দক্ষ সংগঠক ছিলেন। যখন পঁচাত্তর পরবর্তী এই দেশে কেউ আওয়ামী লীগের নাম উচ্চারণ করতে পারতো না, তখন আমার বাবা টানা ১৮ বছর বাংলাদেশের একটি থানার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।’

আরও পড়ুন স্বাচিপ রাজশাহীর সভাপতি ডা. জাহিদ, সম্পাদক ডা. অর্ণা দীর্ঘ ২৭ বছর বরিশালে স্বাচিপের কমিটি, প্রথমবারের মতো শেবাচিমে

এছাড়া সদস্যদের মধ্যে একাধিক জনের পরিচয় পাওয়া গেছে, যারা স্বাচিপ এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। যাদের ফেসবুক পোস্টে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচারণা ও স্বাচিপের পদে তাদের নাম রয়েছে।

সংগঠনের ১ নম্বর সদস্য সুমন সেন। তিনি শান্তি সমাবেশের আয়োজকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি পুলিশ হাসপাতালের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ছিলেন।

দুই নম্বর সদস্য লোকমান হোসেন। তিনি শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের আরএস ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসাসেবায় বাধা দেওয়ার অভিযোগে ৫ আগস্টের পর তাকে আরএস পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

তিন নম্বর সদস্য নীতিশ দাস সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক। তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ ও কর্মজীবনে স্বাচিপে সক্রিয় ছিলেন। শান্তি সমাবেশের দন্ত বিশেষজ্ঞদের নেতা তিনি।

৬ নম্বর সদস্য আসিফ মাহমুদ সহকারী পরিচালক হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার মামা স্বাচিপের বড় নেতা হওয়ায় সুবিধা পেয়েছেন ছাত্রলীগে।

১০ নম্বর সদস্য নিহার রঞ্জন। তিনি নিটোরের অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত। তিনি বিএমএ এর নির্বাচিত কাউন্সিলর। রাজশাহীর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা।

১১ নম্বর সদস্য আল মাহমুদ লেমন। তিনি ঢাকা মেডিকেলে চক্ষু বিভাগের আরএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার সঙ্গে বিশেষ সখ্য ছিল সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সুমনের।

১২ নম্বর সদস্য সাইদুর রহমান সোহাগও স্বাচিপের সক্রিয় কর্মী বলে জানা গেছে।

১৩ নম্বর সদস্য উম্মন ইশরাত ওরফে ইসরাত জাহান উম্মন, পড়ালেখা করেছেন বরিশাল মেডিকেলে। তিনি স্বাচিপ ও ছাত্রলীগে সক্রিয় ছিলেন।

১৪ নম্বর সদস্য মাহমুদুর রহমান মাসুদ। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের ঘনিষ্ঠজন। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড স্বাচিপের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির ইউরোলজি বিভাগের রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত তিনি।

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ড্যাবের এক নেতা বলেন, আমরা বিভিন্ন গ্রুপে দেখেছি স্বাস্থ্য খাতকে অস্থিতিশীল করার জন্য তারা অনেক বেশি সক্রিয় হয়েছে। এমনকি প্রতিটি ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটিও তারা দিচ্ছে। যে সংগঠনের মূল পর্যায়ের বেশিরভাগ নেতাই আওয়ামী ঘরনার ও স্বাচিপ নেতা। তাদের মাধ্যমে ডাক্তাররা উপকারের জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদস্য সচিব ডা. উম্মে তানিয়া নাসরিন জাগো নিউজকে বলেন, যারা বলছে তাদের বলুন তারা যেন স্বাচিপের কোনো লিস্টে আমাদের নাম আছে তা দেখাক। তারা যেসব স্ক্রিনশট বা লিস্টের কথা বলছেন আমরাও এমন অনেক লিস্ট দেখাতে পারবো। আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল তখন আমরা ওই সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছি। যেখানে আমাদের আহ্বায়ক ভুলে দেশনেত্রী বলে ফেলেছিলেন। তখন আমাদের জামায়াত-শিবির ট্যাগ দিয়ে পেটানোর হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এসবের স্ক্রিনশটও আছে আমাদের কাছে। এখনও আমাদের একইভাবে আওয়ামী লীগ ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন রোগীর স্বজনকে লাথি দেওয়ার অভিযোগে চিকিৎসককে তলব  প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকদের ভাতা ৫০ হাজার টাকা করা উচিত

এডহকের যারা এসব বলছেন, এডহক নিয়োগ হয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের স্ব-পুনর্বাসনের জন্য। তারা বিসিএস বাইপাস করে ছাত্রলীগ নেতা, বড় বড় ব্যববসায়ী ও মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য। যাদের বেশিরভাগ বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। নর্থ-বেঙ্গল কলেজের মতো অচেনা একটি বেসরকারি মেডিকেল ৪০ জন এডহকের মাধ্যমে ঢুকেছে। এরপর এতগুলো বিসিএস গেছে এর মধ্যে ওই মেডিকেলের কতজন শিক্ষার্থী ক্যাডার হয়েছে সেই তথ্য নিলে আপনি এডহক নিয়োগের উদ্দেশ্য বুঝতে পারবেন।

আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যখন আওয়ামী লীগ বিরোধীদল ক্ষমতায় ছিল তখন তিনি আওয়ামী লীগ করতেন এটা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতাকালীনসময়ে আমার বাবা মারা গেছেন। আমার বাবা আওয়ামী লীগ করতেন। এর দায় তো আমার না। যারা অভিযোগ করছে তারা দেখাক আমি কোথাও বলেছি কি না যে আমি আওয়ামী লীগ বা স্বাচিপ করি। আমার পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগ, বিএনপি করতে পারে। কিন্তু একজন সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে আমাদের প্রকাশ্যে দল করার সুযোগ নেই।

বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাবের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মেহেদী হাসান জাগো নিউজকে বলেন, স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন এডহক নিয়োগ ও ক্যাডার-ননক্যাডার ইস্যু সামনে এনে ঝামেলা করছে। স্বাস্থ্য বিভাগে যথেষ্ট পদ আছে। এখানে বিসিএস ক্যাডারদের পদায়ন করতে সমস্যা হচ্ছে এমন নয়। তারা যতটা না স্বাস্থ্য ক্যাডারের দাবি নিয়ে সোচ্চার তার থেকেও বেশি একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে। বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন নামক সংগঠনটি যে সময়ের স্বাচিপ ও ছাত্রলীগের যারা ছিল তাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে। এখানে নিরপেক্ষ ভাবাপন্ন কাউকে স্থান দেওয়া হয়নি। এখানে স্বাপিচের বিপরীতে ড্যাব কিংবা এনডিএফ ভাবাপন্ন কোনো চিকিৎসক নেই। ফলে এটা সর্বজনীনভাবে চিকিৎসক বা বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারদের রিপ্রেজেন্ট করে না। এরা একটি দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের সংগঠনে পরিণত হয়েছে।

স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর দেশের সব খাতে একটা ভঙ্গুর অবস্থা বিরাজ করছে। সেখানে স্বাস্থ্য বিভাগটা অস্থিতিশীল রাখার জন্য তাদের বর্তমান কর্মকাণ্ড। তাদের বেশিরভাগের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ততা আছে। অনেকে বিভিন্ন ইউনিটের সক্রিয় নেতাকর্মী।

বিভিন্ন ইউনিট কমিটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটা পেশাগত ক্যাডার সংগঠনের হতে আগে দেখিনি। স্বাস্থ্য ছাড়া অন্য ক্যাডারাভিত্তিক সংগঠনগুলোর এমন কমিটি দেওয়ার নজির নেই। এটা তাদের ভবিষ্যৎ দুরভিসন্ধির পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়। এটা স্বাচিপের একটি বি-টিমে পরিণত হয়েছে। এখানে নিউট্রাল ও ভিন্নমতের কোনো বিসিএস চিকিৎসক নেই। স্বাস্থ্য ক্যাডারদের মধ্যে এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ফলে শিগগির সর্বজনীন একটি বিসিএস হেলথ ক্যাডার সংগঠন গঠন হবে বলে আশা করি।

এএএম/এমআইএইচএস/এসএইচএস/জিকেএস