নাম হুরাসাগর হলেও এটি কিন্তু সাগর নয়। তবে বর্ষায় ফুলে-ফেঁপে উঠলে অনেকটা সাগরের আমেজ তৈরি হয়। এটি পাবনার বেড়া উপজেলার উপর দিয়ে যাওয়া যমুনা নদীর একটি শাখা নদী। হুরাসাগরের পাড় মূলত বেড়া পোর্ট এলাকা বলে পরিচিত। বর্ষা মৌসুমে এই পোর্ট এলাকাটি জমজমাট হয়ে ওঠে হাজারো বিনোদনপ্রেমী মানুষের ভিড়ে।
Advertisement
পাবনার বিভিন্ন উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী জেলা থেকেও অনেকে সপরিবারে এখানে বেড়াতে আসেন। তারা নদীপাড়ে সময় কাটানোর পাশাপাশি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে নদী ভ্রমণ করে আনন্দ উপভোগ করেন। শিশুরাও মেতে ওঠে নির্মল আনন্দে। স্থানীয় জনসাধারণ এখানে একটি স্থায়ী পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও এলাকাবাসী জানান, নৌ-বন্দর পুনরুজ্জীবিত প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০০৬ সালে বেড়া পৌর এলাকার ডাকবাংলোর পাশে নৌঘাট নির্মাণ শুরু করে। তখন পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নদী পাড় সিঁড়ির মতো করে বাঁধানো হয়। নানা জটিলতায় ওই প্রকল্পটি বাতিল করা হয়। এতে বাঁধানো ঘাটের অংশটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
ধীরে ধীরে এলাকাটি মানুষের কাছে ভ্রমণের জায়গা হিসেবে গড়ে ওঠে। বেড়া পোর্ট বলে পরিচিতি পাওয়া এ এলাকায় সারাবছরই লোকজন বেড়াতে যান। তবে জমজমাট হয়ে ওঠে বর্ষা এলে। নদীপাড়ের বটগাছ ও সড়কের ওপর মেলা বসে। সেখানে নাগরদোলা, চরকি, নৌকা দোলনা, বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরনের রাইডস থেকে শুরু করে খাবারের অনেক দোকান বসে।
Advertisement
অন্যদিকে নদীর কূলে গড়ে উঠেছে ‘ভাসমান রেঁস্তোরা’। বাঁধানো ঘাটজুড়ে অর্ধশতাধিক নৌকাও থাকে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত। আছে প্লাস্টিকের প্যাডেল বোটও। বেড়াতে আসা লোকজন সেগুলো ভাড়া করে হুরাসাগর নদে বেড়াতে যান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল নিয়ে পোর্টে বেড়াতে এসেছেন। কেউবা এসেছেন ব্যাটারিচালিত রিকশা অথবা অটোভ্যানে চড়ে। শুধু বেড়া উপজেলাই নয়, পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন উপজেলার মানুষ, এমনকি পাবনা ও সিরাজগঞ্জ শহরের মানুষও প্রতিদিন পোর্টে বেড়াতে আসেন।
আরও পড়ুন
নেত্রকোনা ভ্রমণে ঢুঁ মারুন মেঘালয়ের পাদদেশে টিলার উপর হজমটিলাবেড়ার পায়না থেকে সপরিবারে বেড়াতে এসছিলেন নূর মোহাম্মদ। তিনি জানান, সময় পেলেই তারা পরিবারসহ এখানে বোড়তে আসেন। শীতল কুমার তরফদার বেড়ায় চাকরি করেন। সময় পেলেই বিকেলে পোর্টে এসে সময় কাটান বলে জানান।
Advertisement
বেড়া পল্লী উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করেন আব্দুল ওয়াহাব। তিনি তার স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে ঘুরতে এসেছিলেন। তিনি জানান, বিনোদনের জায়গার খুব অভাব। তাই সময় পেলেই তিনি এখানে বেড়াতে আসেন। মাদ্রাসার কয়েক ছাত্র জানায়, তাদের বেড়ানোর সুযোগ কম। তাই তারা বাড়ির কাছে এমন সুন্দর জায়গায় ঘুরতে এসেছেন।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলা থেকে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বেড়াতে আসা সাগর হোসেন বলেন, ‘এই জায়গাটি (পোর্ট) ছাড়া আশপাশে বেড়ানোর তেমন ভালো জায়গা নেই। এখানে কক্সবাজার বা কুয়াকাটা সৈকতের আমেজ পাই। তাই ছুটি পেলে এখানে প্রায়ই বেড়াতে আসি।’
পাবনার ফরিদপুর উপজেলার বাসিন্দাা ও স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষক এইচএম আহসান উদ্দিন মাসুম জানান, সময় পেলেই তিনি পরিবরাসহ বোড়তে আসেন। তিনি মূলত নৌকা ভ্রমণের জন্য এখানে আসেন। স্থানীয় বাসিন্দা হৃদয় হোসেন বলেন, ‘পোর্ট এলাকাটি অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। আমরা তো এখানে বেড়াতে আসিই, বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে তাদেরও স্থানটি দেখানোর জন্য আনা হয়।’
নানা পেশার মানুষ বিনোদন কেন্দ্রটি ঘিরে মৌসুমি উপার্জন করছেন। একটি নৌকার মাঝি আশকার আলী জানান, এখানে ৪ মাস নৌকা চালানোর সুযোগ হয়। লোকজন হুরাসাগরের উল্টো পাড়ে গ্রামের ভেতরে নৌকায় বেড়াতে যান। কেউ কেউ আবার নদের উজানে বা ভাটির দিকেও যান।
তার নৌকায় ২০ টাকায় আধা ঘণ্টা বেড়ানোর সুযোগ থাকে। প্রতিদিন তার আয় হয় ১৭০০-১৮০০ টাকা। বেড়া নতুনপাড়া মহল্লার সবুজ মিয়া এখানে ভাসমান রেঁস্তোরা দিয়েছেন। সেখানে বেশ কয়েকজন লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে বলে জানান।
সারাবছর পানির প্রবাহ তৈরি করে আধুনিক বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানিয়ে আসছেন স্থানীয়রা। এখানে যদি বারো মাস পানির প্রবাহ থাকত, তাহলে সারা বছরই এখানে মানুষ বেড়াতে আসতেন। এতে বহু মানুষের স্থায়ী কর্মসংস্থান হত।
এজন্য নদী খনন করে এখানে স্থায়ী ক্যানেল করা দরকার। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ার এ বিশাল নৌঘাটটিতে একটি মনোরম পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে বলে তিনি জানান।
এদিকে লোকজনের ভীড়ে অপরিচ্ছন্ন পরিবশে কিছু জমা আর্জনার কারণে দৃষ্টিকটু লাগে বলে ভ্রমণপিপাসুরা জানান। এ ব্যাপারে বেড়া পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী ফিরোজুল আলম বলেন, পোর্ট এলাকা জঞ্জালমুক্ত করার জন্য আমরা ইতিমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছি।
বেড়ার সহকারী কমিশনার( ভূমি) রিজু তামান্না জানান, প্রশাসনিক নজরদারির কারণে এখানে দর্শনার্থীরা এখানে নিরাপত্তার সঙ্গে ঘুরতে পারছেন। জেএমএস/এমএস