রাজধানীতে যানজটের জন্য জুলাইতে দোষারোপ করা হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনকে। ওই যানজনটা পুরো ঢাকায় ছিল না। এর তীব্রতা ছিল মূলত শাহাবাগ, নিউমার্কেট, সায়েন্সল্যাব, বাড্ডা, রামপুরা, মিরপুরসহ আশপাশের এলাকায়। আন্দোলন সফল, শেখ হাসিনার সরকারের বিদায় শেষে গত ক’দিন ধরে হঠাৎ আবার জেঁকে বসেছে যানজটের যন্ত্রণা। কার্যদিবস বা বন্ধের দিন নয়, সপ্তাহের প্রায় সবদিনই যানজট গোটা ঢাকায়। এর রহস্য বা ফের নিয়ে আলোচনা একটি নিষ্পত্তিহীন নতুন বিষয়। এবার আরো ব্যতিক্রম হলো কেবল দিনে নয়, রাত বারোটা একটা পর্যন্তও কোনো সড়কে যানজট লেগে থাকছে।
Advertisement
উড়াল সড়ক, উড়াল সেতু, মেট্রোরেলও যানজটের যন্ত্রণা থেকে রেহাই দিতে পারছে না। যানজটের কারণে বিশ্বে অচল শীর্ষ ১০টি নগরীর মধ্যে রাজধানী ঢাকা অনেক আগেই ঠাঁই করে নিয়েছে। এ নিয়ে নানা বিশ্লেষণে বলা হয়ে থাকে, সড়কের তুলনায় রাজধানীতে গাড়ি অনেক বেশি। আবার পথচারী ও গাড়িচালকদের অসচেতনতাকেও দায়ী করা হয়ে থাকে। এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে অনেক। নানা পরামর্শ ও তাগিদের প্রেক্ষিতে কিছু পদক্ষেপ নেয়াও হয়েছে। কিন্তু, ফল যেই লাউ সেই কদুতেই। যাহা বায়ান্ন তাহাই তেপ্নান্ন। এ রকম সময়ে যানজটের বিষয়টিতে প্রধান উপদেষ্টার মনোযোগ। রাজধানীর যানজট কিভাবে কতোটুকু কমানো যায় তা জানতে বৈঠক ডাকলেন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায়।
কয়েকটি পরামর্শ বাতলে দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের পরিবহনবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন ও অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান । ঢাকার মূল সড়কে রিকশা চলতে না দিলে যানজট অনেক কমে যাবে বলে মত দিয়েছেন তারা। আর দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে বলেছেন ঢাকায় চলাচলকারী সব বাসকে একটি কোম্পানির অধীনে নিয়ে আসতে। পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঢাকায় যানজটের কারণে বছরে অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়। আর যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হামলার মুখে পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ঢাকায় বেশ কয়েক দিন ট্রাফিক পুলিশ ছিল না। ট্রাফিক সামলেছেন শিক্ষার্থীরা।
ক’দিন ধরে আবার ট্রাফিক পুলিশ রাস্তায় নেমেছে। তবে, তাদের মনোবল ফেরেনি। কাজে গতি আসেসি। তারা সংখ্যায়ও কম। দায়িত্ব অনেক। এই সুযোগে ঢাকার সব রাস্তায় ভীষণ দাপটে নেমে পড়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। এরা ভীষণ বেপরোয়া। কোনো আইন-কানুন, নিয়মের ধার ধারে না। অটো রিকশার সাথে ফিটনেসবিহীন বাসসহ অন্যান্য যানবাহনও নেমে পড়েছে। তাদেরও এক ধরনের স্বরাজ চলছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বুয়েটের এ বিষয়ক এক্সপার্ট দুই অধ্যাপকের বৈঠক। যেখানে আরো কিছু পরামর্শ এসেছে। যেমন - শহরের মোড়গুলোর ৫০ থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ কোনো ধরনের যানবাহন যাতে থামতে না পারে, পার্ক করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা। বাস থামার নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যাত্রী ওঠানামা করতে না দেওয়া। কোনো বাস পাশাপাশি দাঁড়াতে পারবে না, একটার পেছনে আরেকটাকে দাঁড়াতে হবে।
Advertisement
ভ্রাম্যমাণ ট্রাফিক পর্যবেক্ষক দল গঠনের কথাও এসেছে। নির্দিষ্ট এলাকায় দায়িত্বরত সেই দলে একজন ট্রাফিক পুলিশ ও একজন ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার থাকবেন। তাঁরা নির্দিষ্ট এলাকায় সব সময় চলাচল করবেন। তাঁদের দায়িত্ব হবে রাস্তায় নিয়মের কোনো ব্যত্যয় পর্যক্ষেণ করা। এসব পরামর্শ কতোটা কার্যকর সম্ভব, প্রশ্ন আছে। প্রশ্ন আছে বাস্তবতা নিয়েও। ঢাকা শহরের তিন ভাগের মধ্যে দুই ভাগ এলাকায় অপরিকল্পিত এবং রাস্তাঘাট কম। এ রকম অবস্থায় যাত্রার বেশির ভাগ পূরণ করতে হয় গণপরিবহন দিয়ে। বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার গণপরিবহনের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর হলো মেট্রোরেল। একটি মেট্রোরেল হয়েছে, আরও দুটি মেট্রোরেল ২০২৭ সালের মধ্যে হওয়ার কথা। সেই পর্যন্ত বাকি জায়গায় বাস দিয়ে চাহিদা পূরণ করতে হবে। এ বৈঠক ও প্রস্তাবনা পর্বের আগে, রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে দ্রুত ও কার্যকর সমাধান খুঁজতে পুলিশ ও দেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বৈঠক করেছেন সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সাথে। সেখানে মূল কথা ছিল- ‘যানজট নিরসন করতেই হবে’।
যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে ঢাকার এবং ঢাকায় আসা সব মানুষের চরম বিরক্তি, সেগুলোর অন্যতম একটি হচ্ছে রাজধানীর যানজট নিরসন। মানুষ নগদে এবং সম্ভব হলে আজই-এখনই এর সমাধান চায়। রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে আটকে থাকা নিয়তির মতো হয়ে গেছে তাদের। রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া বা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জরুরি কাজে বের হয়ে মানুষ কী যাতনায় পড়ে তা হাড়ে হাড়ে ভোগেন ভুক্তভোগীরা। যে কারণে কারণে খুব জরুরি কাজ ছাড়া কোথাও যাওয়াই বন্ধ করে দেয়া মানুষের সংখ্যা অনেক। কিন্তু, কর্মজীবীদের বের হতেই হয়। হাতে দুই-তিন ঘন্টা সময় রেখে কাজে বের হওয়া মোটেই সমাধান নয়। একদিকে শব্দ দূষণ-বায়ুদুষণে আমাদের ঢাকা বিশ্বের নিম্নসূচকে কলঙ্কিত। তারওপর যানজটে বসে বসেই নানা রোগ ও স্বাস্থ্য সমস্যা হাছিল হচ্ছে মানুষের। সময় ও অর্থ নষ্টের বাইরে এই রোগ অর্জনের বিষয়টি সেভাবে আলোচনায় আসার অবকাশই বা কোথায়?
এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে কারো কারো মধ্যে হেঁটেই পথচলার দিকে ঝুঁকছেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে ঢাকা শহরের কোনো কোনো রাস্তায় গাড়ির গড় গতি হাঁটার গতির চেয়ে কম। তথ্য হিসেবে সঠিক। তাই বলে দীর্ঘপথ নিয়মিত হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। আর যানবাহন এড়িয়ে হাঁটলে গাড়ির ধোঁয়া-শব্দ থেকে রেহাই মেলার সুযোগ নেই। বরং শব্দ দূষণ, ধোয়া দূষনের শিকার আরো বেশি হতে হয়। আবার এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে গাড়িতে ওঠে ঝিম মেরে বসে থাকার মাঝে আরেক যন্ত্রণা। এটি মানসিক চাপ বাড়ায়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানবাহন এক জায়গায় অনেক সময় ধরে আটকে থাকলে গাড়ির ইঞ্জিনের ধোঁয়া ও কাঁপুনি ফুসফুসের যে ক্ষতি করে ছাড়ে তা অনেকের ধারণারও বাইরে। এতে কার্বন মনোক্সাইড, ডাইঅক্সিন, নাইট্রিক অক্সাইড, সালফার অক্সাইড এরকম নানা গ্যাস বাতাসের সাথে মানুষের ফুসফুসে চলে যায় অনায়াসে। তা শ্বাসকষ্ট-হাঁপানি, ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ, ইন্টারস্টিসিয়াল লাঙ ডিজিজের শঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। ঢাকার রাস্তায় চালকদের নিজেদের মধ্যে অথবা যাত্রীদের সাথে ঝগড়া, হাতাহাতি, মারামারির নিত্য ঘটনা যাত্রীসহ আশপাশে মানুষকে কী মাত্রায় স্নায়ুরোগে আক্রান্ত করে তা বুঝতে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।
যানজটের কারণে মানুষজনের মধ্যে যে ক্রোধ, আক্রমণাত্মক, মারমুখী, অস্থির, খিটখিটে আচরণ তৈরি হচ্ছে- তা বোঝা কেবল উপলব্ধির ব্যাপার। প্রতিদিনই যানজটে বসে রাগ, খিটখিটে মেজাজ ও উদ্বেগের একজন ব্যক্তিকে দিয়ে সারাদিন কতোটুকু কাজ হবে? তাই যানজট নিয়ে বৈঠক, গবেষণা, কমিটির যা-ই হোক দ্রুত এর অবসান চাই। শটকার্টে হলেও অন্তত কাজ শুরু হোক। মানুষ আর পারছে না। নানা জরুরি কাজের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার যানজটকে এভাবে আমলে নেয়া মানুষকে আশা দেখাচ্ছে। এবার বোধ হয়, কিছু একটা হবে-এমন আশা অনেকের।
Advertisement
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
এইচআর/এএসএম