বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মুক্তচিন্তার কেন্দ্র। সেখানে মুক্তজ্ঞানের চর্চা হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আঘাত তখনই আসবে যখন মৌলবাদ ঢুকে যাবে। মুক্তচিন্তার বিরোধী হচ্ছে মৌলবাদী চিন্তা। এই বিরোধ নতুন নয়। সম্প্রতি দেশে যে খুনের অপতৎপরতা চলছে তা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ঘটছে। কিন্তু ক্ষমতায় যারা আছেন তাদের এব্যাপারে আগে থেকে সক্রিয়তার জন্য কারো কোনো চিন্তা নেই। সে কারণে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঠেকানো যাচ্ছে না। সম্প্রতি বিশিষ্ট নাট্যকার ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর মলয় ভৌমিক একান্ত সাক্ষাৎকারে জাগো নিউজকে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতায় যারা আছেন তারা শুধু বলছেন দেশে আইএস নেই। আইএস খুন করেনি। কিন্তু দায় স্বীকারের খবর আমরা পাচ্ছি। তবে খুন যেই করুক দেশের মানুষই তো মরছে। এর দায় তবে কার?’রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর একেএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডের পর জাগো নিউজের মুখোমুখি হন প্রফেসর মলয় ভৌমিক। ওই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে আরো নানা বিষয়। পাঠকদের উদ্দেশ্যে চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষ পর্ব।মলয় ভৌমিক : বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্টটা কি? বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর আঘাত আসবে এটাই তো স্বাভাবিক। কারণ এখানে প্রগতির চর্চা হয়। মুক্তজ্ঞান চর্চা হয়। আর মুক্তজ্ঞান চর্চা তো মৌলবাদ চর্চার বিরুদ্ধে যায়। সুতরাং আঘাত তো এখানেই আসবে। পৃথিবীব্যাপী এই আঘাতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর হয়।মৌলবাদীদের চিন্তা স্থবির, স্থির। তারা নিজেদের শ্রেষ্ট ভাবে। আর এই শ্রেষ্টত্বের অহঙ্কার থেকে তারা আঘাত করবেই।তিনি বলেন, শিক্ষকরা বর্তমানে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি ও যুক্তিবাদী জ্ঞানের চর্চা থেকে বহু বহু দূরে রয়েছে। আখের গোছানো নিয়েই ব্যস্ত তারা। গতানুগতিক দু’একটা মানববন্ধন করেই দায় সারছেন। এতে কিচ্ছু হবে না। বরং সেই জায়গায় যদি জাগরণ তৈরি করা যায়, যদিও তা দীর্ঘমেয়াদি তবুও সম্ভব। কাজ করতে হবে এখান থেকেই।এটা সাধারণ আইনশৃঙ্খলার ব্যাপার নয়। পাশের বাড়িতে ডাকাত ধরা পড়লে আরেক ডাকাত সাবধান হয়। কিন্তু এটা তো তা নয়। যারা এসব করছে তাদের তো অস্তিত্বের লড়াই। এটা তাদের এক রকম যুদ্ধ। এটা তাদের আদর্শ। তারা এটা করবেই।মাঝেমধ্যে যে হত্যার ঘটনাগুলো ঘটছে, আশপাশের মানুষ বলছে, ব্যাড ইম্পেশন। বলছে, ‘ও নিশ্চয় ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু বলছিল। নাস্তিক ছিল। বাংলাদেশের দায়িত্বশীল জায়গা থেকে আমরা বলতে শুনেছি ধর্মের বিরুদ্ধে যেন কেউ মন্তব্য না করে। এটা ঠিক না।নথিপত্র ঘাটলে দেখা যাবে যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা ধর্মবিরোধী মন্তব্যই করেননি। অথচ মানুষের মধ্যে বিশ্বাস।এখন ব্লগার একটা গালি হয়ে গেছে জানিয়ে মলয় ভৌমিক বলেন, ব্লগাররা ব্লগে লেখেন। টুইট করেন। ওবামা, নরেন্দ্র মোদীও ব্লগে লেখেন। এই জায়গাগুলো কে বোঝাবে। সাধারণ অশিক্ষিত মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে মিথ্যাচার চলছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ৪ জন শিক্ষককে হত্যা করা হলো, কেউ বলতে পারবে না যে তারা কোনো সময় ধর্মবিরোধী কথাবার্তা বলেছিল? সেইটা কিন্তু আমাদের প্রচারে নেই। যারা সরকারের দায়িত্বশীল তারা তো বলতে পারে, যারা এসব করছে, দেখেন ঘটনা এই। তারা মিথ্যাচার করছে। কিন্তু তারা (দায়িত্বশীল) তার প্রতিবাদ করছে না। তারা শুধু একটা কথা জোরেশোরে বলছে, এটা আইএস ঘটায়নি। আইএস করেছে কি করেনি প্রশ্ন তা নয়, মানুষ তো মরছে। তাদের তো উচিত ছিল এটা পরিষ্কার করা। কিন্তু ক্ষমতায় থাকার জন্য কোথায় যেন গাটছাড়া ভাব। তাহলে তো এসব দূর করা যাবে না।এটাকে নেহায়েত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা কিংবা ব্যক্তি রেজাউল করিমের বিষয় হিসেবে দেখছি না। এটা সামগ্রিক বিষয়। এই ঘটনা ঘটতেই থাকবে। যারা ঘটাচ্ছে তারা প্রতিনিয়ত সংখ্যা বাড়াচ্ছে, জানান দিচ্ছে আমরা আছি। তারা হয়তো ৩০টা টার্গেট করে এসব করছে। যেটাতে সুযোগ পাচ্ছে ঘটাচ্ছে। আবার আরেকটা করবে। সেখানে ব্যক্তিকে বিষয় হিসেবে দেখার কিছু নেই। রাবির এই প্রফেসর আরো বলেন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক একেএম শফিউল ইসলাম লিলন হত্যার বিষয়টি রহস্যজনক হয়ে আছে। আমাদের শুরু থেকে মনে হয়েছে এটা জঙ্গিগোষ্ঠীর কাজ। এটা একদম পরিষ্কার। পুলিশ বলছে জঙ্গি, র্যাব বলছে বিএনপি। এটা করা মানে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। কিন্তু এতে করে তো প্রকৃত খুনিরা আড়ালে পড়ে যাচ্ছে।রেজাউল হত্যায় গত কয়েক দিনে কোনো অগ্রগতি নেই। অগ্রগতি আমার দৃষ্টিতে, চেয়েও কোনো লাভ নেই। প্রি-অ্যাকটিভ কিছু করা গেলে তবেই কিছু ঘটবে না। আমরা চাইতে পারি আর যেন খুনের ঘটনা না ঘটে। কিন্তু ফাঁসির মঞ্চে দু’একজনকে মেরে লাভ নেই। আমি নিষেধ করছি না। একটা উইং এজন্য কাজ করতে পারে। কিন্তু আসল জায়গায় তো কিছু হচ্ছে না।আমরা তো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশটা চিনি। তাহলে কেন সাড়াশি অভিযান সব সময় থাকছে না। হলে কি হয়, ম্যাচে কি হচ্ছে? পুলিশ কি চেনে না? আসলে টাকা দিয়ে ম্যানেজ হয়। ছাত্রলীগের মিছিলে কারা কাজ করে? নেতারাও অস্বীকার করতে পারবে না। মেয়েদের হলেও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় কি হচ্ছে? ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ধর্মীয় আলোচনার কথা।আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি করবো না বলেই বলছি যে, রেজাউল করিম হত্যার এই কয়েকদিনেও কোনো অগ্রগতি নেই তাহলে আসল জায়গা থেকে সরে আসা হবে। মরুক বিচার তো হবেই। তাহলে আমি অগ্রগতি চাইলেও তো পাবো না। প্রিএকটিভ কিছু না হলে তো অগগ্রতি আসবে না। যোগ করেন তিনি। মলয় ভৌমিক বলেন, বিচারের একটা প্রক্রিয়া থাকবে। শিক্ষকদের সামাজিক জাগরণে নেই। তাদের আনতে হবে। ইয়াং জেনারেশনকে আনতে হবে। সরকারকে বলতে হবে, মিথ্যে কথা বলে হত্যা করা হচ্ছে।দেখুন নিরীহ মানুষ রেজাউল। তাকে আমরা চিনি। কখনো ধর্মের বিরুদ্ধে অশোভন কিছু বলেননি। অথচ তাকে হত্যা করা হলো। কিন্তু কেউ বলছে না। রাষ্ট্রীয় প্রচার যন্ত্রও নীরবতায়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এই গেম সবাই খেলে। সেটা তারা তো ঘায়েল এমনিতেই হবে। প্রমাণ করতে হবে এদের সঙ্গেই তাদের গাটবাধা। কিন্তু তা না করে সরাসরি নির্দিষ্ট প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। এটা দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া। এতে প্রকৃত খুনিরা আড়ালে থেকে যাচ্ছে।মলয় ভৌমিক একজন খ্যাতনামা নাট্যকার, অভিনেতা, নির্দেশক, ও শিক্ষাবিদ। বাংলাদেশের পথনাটক আন্দোলন, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে মুক্ত নাটক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। পেশায় রাবির অধ্যাপক হলেও তিনি একজন নাট্য ব্যক্তিত্ব হিসাবেই বেশি পরিচিত।মলয় ভৌমিক ১৯৫৬ সালের ১ মে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার কানসোনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে এসএসসি ও ১৯৭৪ সালে এইচএসসি পাশের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগ হতে ১৯৭৭ সালে বি.কম. ও ১৯৭৮ সালে এম.কম. সম্পন্ন করেন। ১৯৮২ সালে এই বিভাগেই শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি।ছোটবেলা থেকেই তিনি পড়াশুনার পাশাপাশি সৃজনশীল অনেক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। মূলত তিনি নাটকের মানুষ হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। তিনি দৈনিক সংবাদ, দৈনিক সংবাদে `উত্তরের উলুখাগড়া` ও দৈনিক যুগান্তরে `বহে প্রান্তজন` নামে লিখতেন। বর্তমানে তিনি দৈনিক প্রথম আলোতে কলাম লিখেন।তিনি ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (রাবিসাস) সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক জোট প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ ১৯৮৪-১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি জোটের আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত অনুশীলন নাট্যদলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মলয় ভৌমিক। তিনি এখন পর্যন্ত ৩৫ টির বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন। তিনি ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বেতারে নিয়মিত নাট্যশিল্পী ছিলেন। তিনি বিটিভি ও বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনে নাট্যকার ও নাট্য শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। তার রচিত মৌলিক নাটক ৩০ টিরও বেশি। এছাড়াও তিনি ৩২টি নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন।জেইউ/একে/এমএস
Advertisement