জাতীয়

আসন ফাঁকা রেখেই উড়ছে বিমান, মাসে লোকসান ২০ কোটি

বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা যাচাই না করে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঢাকা-নারিতা রুটে ফ্লাইট চালু করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এর ফল মিলছে হাতেনাতে। প্রথম আট মাসেই রুটটিতে লোকসান ১৬৬ কোটি টাকার বেশি। লোকসান কমাতে এরই মধ্যে ফ্লাইট সংখ্যা কমানোসহ নানান পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা।

Advertisement

অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা-নারিতা রুটে বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা যাচাই না করায় এই লোকসানের মুখে পড়েছে বিমান। এখন ‘ইজ্জত বাঁচাতে’ রুটটিতে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধও করতে পারছে না সংস্থাটি।

অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স একটি সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। তাই সংস্থাটিকে বাণিজ্যে ফোকাস করা দরকার ছিল। কিন্তু ঢাকা-নারিতা রুটে তা করা হয়নি। আগের লোকসানের কারণ থেকেও তারা শিক্ষা নেয়নি। ফলে এখন প্রায় অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখেই ফ্লাইট পরিচালনা করতে বাধ্য হচ্ছে বিমান। এভাবে লোকসান দিয়ে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।

বিমানের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ১৯৭৯ সালে ঢাকা-নারিতা রুটে ফ্লাইট চালু করেছিল বিমান। ১৯৮১ সালে সাময়িক বিরতির পর আবার তা চালু হয়। কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক যাত্রী না পাওয়ায় টানা লোকসানের কারণে ২০০৬ সালে ঢাকা-নারিতা-ঢাকা রুটে ফের ফ্লাইট বন্ধ করে বিমান কর্তৃপক্ষ। এর ১৭ বছর পর কোনো বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর আবার নারিতা ফ্লাইট চালু করা হয়। এরই মধ্যে প্রথম আট মাসের যাত্রী পরিবহন, রাজস্ব আয় ও পরিচালনা ব্যয় নিয়ে একটা পর্যালোচনা করেছে বিমানের সংশ্লিষ্ট শাখা।

Advertisement

এ দুটি গন্তব্যে যাত্রী পরিবহনে বিমানের লোকসান অনেক বেশি। তাই এ দুটি রুটে একটি করে ফ্লাইট কমানোর কথা বলেছি। আবার ইতালির রোম ও কানাডার টরন্টোতে যাত্রী চাহিদা আছে। সেখানে একটি করে ফ্লাইট বাড়ানোর কাজ চলছে।- বিমানের এমডি ও সিইও মো. সাফিকুর রহমান

ওই পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বিমান মোট লোকসান দিয়েছে ১ কোটি ৩৮ লাখ ৪০ হাজার (১৩ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা দাঁড়ায় ১৬৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা (তৎকালীন মুদ্রা বিনিময় হার অনুযায়ী)। অর্থাৎ গড়ে প্রতি মাসে লোকসান হচ্ছে ২০ কোটি টাকা।

আরও পড়ুনশাহজালাল বিমানবন্দরের সেবায় আমূল পরিবর্তন, খুশি যাত্রীরাবিমানে এবার অভিজ্ঞ এমডি, সেবায় পরিবর্তনের প্রত্যাশাঅক্টোবরেই তৃতীয় টার্মিনাল বুঝে নেবে বেবিচক, ফ্লাইট চালু কবে?

জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সাফিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিগত সময়ে সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই বেশ কিছু রুটে বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে জাপানের নারিতা ও যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার অন্যতম। এ দুটি গন্তব্যে যাত্রী পরিবহনে বিমানের লোকসান অনেক বেশি। তাই এ দুটি রুটে একটি করে ফ্লাইট কমানোর কথা বলেছি। আবার ইতালির রোম ও কানাডার টরন্টোতে যাত্রী চাহিদা আছে। সেখানে একটি করে ফ্লাইট বাড়ানোর কাজ চলছে। এভাবে সমন্বয় করে বিমানকে লোকসানের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি।’

বিমানের ঢাকা-নারিতা রুটের লাভ-ক্ষতিবিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগ সূত্র জানায়, বাংলাদেশ বিমানের বহর মূলত যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বোয়িং উড়োজাহাজনির্ভর। তারপরও ২০২৩ সালে ফ্রান্সের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস কোম্পানি বিমানে উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব দেয়। তখন আবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েন চলছিল। তাই এয়ারবাসের প্রস্তাবের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।

Advertisement

এমন অবস্থায় বিমান কর্তৃপক্ষ জাপানের নারিতা, ইতালির রোম ও কানাডার টরন্টোতে ফ্লাইট চালু করে নতুন উড়োজাহাজ কেনার প্রেক্ষাপট তৈরির চেষ্টা করে। এ কাজে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন বিমানের তৎকালীন এমডি ও সিইও শফিউল আজিম। তিনি তখন এটাকে শেখ হাসিনা সরকারের কৃতিত্ব হিসেবে প্রচার করেন। পরবর্তীসময়ে শফিউল আজিমকে তার ব্যাচের অনেককে ডিঙিয়ে সচিব করা হয়। বর্তমানে তিনি নির্বাচন কমিশনে সচিবের দায়িত্বে আছেন।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে শফিউল আজিমকে একাধিকবার কল করলেও তিনি ধরেননি। খুদে বার্তায় প্রশ্ন পাঠালেও জবাব মেলেনি।

বিমানের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগ সূত্র জানায়, বিমান বাংলাদেশ বোয়িং ৭৮৭-৮০০ উড়োজাহাজ দিয়ে নারিতা ফ্লাইট পরিচালনা করে। এতে আসন রয়েছে ২৭১টি। প্রতি মাসে ফিরতি ফ্লাইটসহ মোট ফ্লাইট থাকে ২৬টি। সে হিসাবে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে প্রথম ৮ মাসে সর্বোচ্চ ৫৬ হাজার ৩৬৮ জন যাত্রী পরিবহন করার সুযোগ ছিল। কিন্তু এই সময়ে যাত্রী পরিবহন করেছে ২৭ হাজার ৬৯১ জন। অর্থাৎ যে সংখ্যক যাত্রী পরিবহন করেছে, তার চেয়ে বেশি আসন ফাঁকা ছিল।

বিমান যেহেতু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, বিমানের লাভের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সব জায়গায় প্রফেশনাল হতে হবে। মোড়লকে খুশি করার জন্য নতুন রুটে ফ্লাইট চালু করলে সাসটেইনেবল হবে না।- কাজী ওয়াহিদুল আলম

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা থেকে জাপানের নারিতায় সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করে একমাত্র বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এর বাইরে তৃতীয় দেশ হয়ে (ট্রানজিট বা কানেক্টিং) ফ্লাইট পরিচালনা করে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, ক্যাথে প্যাসেফিক, টার্কিশ এয়ারলাইন্স, চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্স ও শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্স। উল্লিখিত আট মাসে অন্য উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো এই গন্তব্যে যাত্রী পরিবহন করে ৭ হাজার ১৯৮ জন। সাধারণত ট্রানজিট বা কানেক্টিং ফ্লাইট হলে ভাড়া কম হয়। আর সরাসরি ফ্লাইটে একটু বেশি হয়। কিন্তু বিমান সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করে অন্য এয়ারলাইন্সের তুলনায় আড়াইগুণ কম ভাড়া নির্ধারণ করেছে।

বিমান বাংলাদেশের এক অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ৮ মাসে এ গন্তব্যে বিমানের আয় হয় ৮ দশমিক শূন্য ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর খরচ হয়েছে ২১ দশমিক ৯২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মোট লোকসান ১৩ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন ডলার বা ১৬৬ কোটি টাকা। ফ্লাইট চালুর আগে এসব লোকসানের বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়নি।

বিমানের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিমান একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। যে কোনো দেশে ফ্লাইট চালুর আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা জরুরি ছিল। কিন্তু বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, নতুন যেসব রুটে বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে, তার কোনোটিরই সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। হুট করে সরকারপ্রধান মনে করলেন নতুন একটি দেশের সঙ্গে বিমানের ফ্লাইট চালু করা দরকার, সেটিই করা হয়েছে। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই করা হয়নি। ফলে গত পাঁচ বছরে যেসব রুটে বিমানের নতুন ফ্লাইট চালু হয়েছে, এখন সবগুলো লোকসানে আছে।’

বিমান বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, এখানে সরকারি চাকরির মনোভাবাপন্ন হওয়া যাবে না জানিয়ে কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘বিমান যেহেতু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, বিমানের লাভের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সব জায়গায় প্রফেশনাল হতে হবে। মোড়লকে খুশি করার জন্য নতুন রুটে ফ্লাইট চালু করলে সাসটেইনেবল হবে না। আবার যে রুটগুলো চালু করা হয়েছে, তা হুট করে বন্ধ করা যাবে না। বিদ্যমান রুটগুলো কীভাবে লাভজনক করা যায়, সে উপায় বের করতে হবে। বিমানের মার্কেটিং পলিসি চেঞ্জ করতে হবে। নিয়োগ দিতে হবে দক্ষ জনবল।’

এমএমএ/এএসএ/জেআইএম