জাতীয়

এক পদ্মা সেতুতেই ধাপে ধাপে বাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা

দেশের অর্থনীতিতে দারুণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে পদ্মা সেতু প্রকল্প। তবে এর নির্মাণব্যয় নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতু ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন প্রকল্পের নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। কয়েক ধাপে ব্যয় বাড়তে বাড়তে সেটা দাঁড়ায় ৩২ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। ফলে এক প্রকল্পেই বাড়ে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।

Advertisement

যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং যেসব প্রকল্প চলমান সবগুলোর আসল রহস্য বের করবে সরকার। যেগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে সেগুলোতে আরও ব্যয় কমানোর সুযোগ ছিল কি না তাও খতিয়ে দেখবে সরকার। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে মেগা প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করার এই তথ্য জানা গেছে।

প্রকল্পগুলোর ব্যয় পর্যালোচনার কাজ করছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকার দেশের অর্থনীতির ওপর যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে সেখানেও মেগা প্রকল্পের ওপর একটি পর্যালোচনা থাকবে। তাতে প্রকল্পগুলোর আদৌ দরকার ছিল কি না; কেন নেওয়া হয়েছিল-এসব খোঁজা হচ্ছে। পাশাপাশি খরচও পর্যালোচনা করা হবে। সেই হিসেবে পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হলেও ব্যয় কোন কোন জায়গায় কমানো যেত তা খতিয়ে দেখা হবে। ১০ হাজার কোটি টাকা থেকে সেতুর ব্যয় কেন বেড়ে ৩২ হাজার কোটি হলো তা খতিয়ে দেখা হবে।

শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টচার্য বলেন, কী কী নিয়ে কমিটি কাজ করবে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। মেগা প্রকল্পসহ অর্থনীতির সার্বিক দিক নিয়ে কাজ করবে কমিটি।

Advertisement

দেখা গেছে, মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছিল ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। এটি বাড়িয়ে ১৩ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকায় উন্নীতের প্রস্তাব করা হয়। একই ভাবে নদীশাসন কাজের জন্য ৯ হাজার ৪০০ কোটি থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়। পরামর্শক খাতের ব্যয় ৭৮৮ কোটি থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকায় উন্নীতের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প ২০০৭ সালের জুলাই মাসে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে জুন ২০১৫ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য একনেকে অনুমোদিত হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ডিসেম্বর ২০১৫ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য এটির প্রথম সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদন পায়। এরপর ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ডিসেম্বর ২০১৮ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য দ্বিতীয় সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। তিনবার সময় বাড়িয়ে জুন ২০২৩ পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। মাঝে বিশেষ সংশোধন করে প্রকল্পের ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়। ডিফেক্ট লায়াবিলিটির নামে আরও ২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে ৩২ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে জুন ২০২৪ পর্যন্ত সময় চেয়ে তৃতীয় সংশোধন করা হয়।

জানতে চাইলে আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, বড় প্রকল্পগুলোর একটি মূল্যায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগির এই পর্যালোচনা শেষ হবে। প্রকল্পগুলো জনবান্ধব ছিল কি না, নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে তা দেখা হবে।

পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হয়ে গেছে এটা খতিয়ে দেখা হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেটা বাস্তবায়িত হয়ে গেছে তার ব্যয় কমাতে পারবো না। তবে ব্যয় কমানোর কোনো জায়গা ছিল না কেন, বার বার ব্যয় বেড়েছে এসব বিষয় দেখা হবে। সার্বিক বিষয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এগুলো কাজ চলছে। ফোকাল পয়েন্ট কাজ করছে। সব মেগা প্রকল্পই দেখা হয়েছে।

Advertisement

পদ্মা সেতুর মতো মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ এবং দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম (মিয়ানমারের কাছে) পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করবে সরকার।

বর্তমানে সাতটি মেগা প্রকল্প চলমান আছে। এসব প্রকল্পে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। এর মধ্যে একমাত্র রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ছাড়া বাকি ছয়টি প্রকল্পের ৯০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। তবে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে এ রকম প্রকল্প নেওয়ার কী প্রয়োজনীয়তা ছিল এবং প্রকল্পগুলো যৌক্তিকভাবে নেওয়া হয়েছে কি না এসব পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

বেশ কিছু প্রকল্প রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল বলে আলোচনা আছে। আবার বেশি অর্থ ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। নতুন সরকার এখন এসব প্রকল্পের অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা খুঁজছে। প্রাথমিকভাবে আইএমইডি কাজ শুরু করেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পের তালিকায় আটটি প্রকল্প ছিল। গত জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। ২২ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প শেষ হয় ৩২ হাজার কোটি টাকায়। পুরো অর্থই জনগণের করের টাকা থেকে জোগান দেওয়া হয়।

২০১২ সালে রাজধানীর উত্তরা থেকে মিরপুর ও ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু করা হয়। এখন চলছে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল সম্প্রসারণের কাজ। মোট প্রকল্প ব্যয় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। জুলাই পর্যন্ত বাস্তবায়ন হার ভৌত অগ্রগতি ৯০ শতাংশ। এই প্রকল্পে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে জাপানের জাইকা। শুধু টিকিট বিক্রির টাকায় এই ঋণ শোধ করতে ৪৫ বছর সময় লাগবে।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ গড়ে তুলতে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের কাজ ৯৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। ট্রেন চলাচল শুরু করেছে। দিনে ৪৮টি ট্রেন চলার কথা; কিন্তু চলে মাত্র ১০টি।

রাশিয়ার ঋণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এটি শেষ হওয়ার কথা। গত জুলাই মাস পর্যন্ত প্রকল্পের মাত্র ৬৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। এ প্রকল্পটির অন্যতম দুশ্চিন্তার বিষয় হলো ২০২৭ সালের শুরু থেকে বছরে প্রায় ৫০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্রগতি হয়েছে ৮৮ শতাংশ। ২০২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ হবে।

পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পটি দুবার সংশোধনের পর খরচ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত ৯৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

জানা গেছে, মোংলা বন্দর থাকা সত্ত্বেও ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে পায়রা বন্দর নির্মাণের উদ্দেশ্য শুধুই রাজনৈতিক। নিয়মিত ড্রেজিং করা না হলে বন্দরটি কার্যকর করা কঠিন।

চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৯৯ শতাংশ। এই পথে ট্রেন চলাচল শুরু করেছে। তবে আপাতত মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে না। দিনে ২৬টি ট্রেন চলাচলের কথা থাকলেও চলছে মাত্র ৬টি। ফলে যেসব উদ্দেশ্যে প্রকল্প নেওয়া হয় তার কোনো উদ্দেশ্যই সফল হয়নি। এসব বিষয়েও খতিয়ে দেখবে সরকার।

এমওএস/এমআইএইচএস/এমএস