দেশের সব তৈরি পোশাকশিল্প কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর)। মালিক-শ্রমিক নেতা, সরকার ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
Advertisement
সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের সব তৈরি পোশাকশিল্প কারখানা খোলা থাকবে রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) থেকে। কোনো কারখানায় অস্থিরতা তৈরি হলে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে।
কিন্তু মালিকরা পূর্ণ আস্থা পাননি। তারপরও শিল্প কারখানা খুলেছেন দেশের অর্থনীতির স্বার্থে। কারখানায় স্বস্তি ফেরা নিয়ে অনেক উদ্যোক্তা শঙ্কায়। কারণ তাদের কাছে এবারের আন্দোলন নতুন, যা ৩০ বছরে তারা দেখেননি। তাদের ভাষায়, এ আন্দোলনে শ্রমিক নেতাদের নেতৃত্ব নেই। নেই কোনো সুনির্দিষ্ট বা যৌক্তিক দাবি। দাবি পূরণের পরও আন্দোলন থামেনি। বরং কাজে ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়েও বর্জন করেছে, চালিয়েছে ভাঙচুর।
‘১৪ দিন পর কারখানা খুলেছি। মনটা ভালো। তবে ভালো থাকবে কি না তা নিশ্চিত নয়। কারখানা কেন বন্ধ হলো আর কেনই বা খোলা হলো জানি না। ৩০ বছর ধরে ব্যবসা করি। এই প্রথম আন্দোলনের কারণ জানি না। আর এটাই বড় আতঙ্ক।’-অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনামুল হক বাবলু
Advertisement
এমনকি পুলিশের কাছেও নেই প্রকৃত অপরাধীদের তালিকা। কারণ পুলিশ সাম্প্রতিক সময়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য কাজে ফিরতে সময় নিচ্ছে। অন্যদিকে বিভিন্ন থানায় হামলার কারণে তাদের মনোবল ভেঙে গেছে এবং আস্থায় ফিরতে সময় নিচ্ছে।
আরও পড়ুনকাল থেকে সব পোশাক কারখানা খোলা থাকবে: শিল্প উপদেষ্টা উৎপাদনে ফিরেছে আশুলিয়ার অধিকাংশ পোশাক কারখানা দ্রুত সময়ে শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণে আসবে: শ্রম উপদেষ্টা শ্রমিক অসন্তোষ সংক্রান্ত অভিযোগ জানানো যাবে ১৬৩৫৭ নম্বরেআন্দোলনের ধরন ও কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই অনেক মালিকের। আর এটাই তাদের জন্য বড় আতঙ্ক।
অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনামুল হক বাবলু বলেন, ‘আজ (শনিবার) ১৪ দিন পর কারখানা খুলেছি। মনটা ভালো। তবে ভালো থাকবে কি না তা নিশ্চিত না। কারখানা কেন বন্ধ হলো আর কেনই বা খোলা হলো জানি না। ৩০ বছর ধরে ব্যবসা করি। এই প্রথম আন্দোলনের কারণ জানি না। আর এটাই বড় আতঙ্ক।’
‘কারখানায় ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়েছে। সব দাবি মেনে নিলাম। শ্রমিকরা চলেও গেলো। কিছুক্ষণ পর আবার আন্দোলন, জেনারেল ম্যানেজারের মাথা ফাটাল। তদন্ত করতে হবে কেন ঘটেছে এবং আন্দোলনে কারা জড়িত’ বলছিলেন বাবলু।
Advertisement
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস বলেন, ‘আমরা অতীতে শ্রমিক অসন্তোষ প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু এতটা জটিল ছিল না। আমি মনে করি, পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি উসকানি দিচ্ছে। শিল্পের স্বার্থে এটা এখনই শেষ হওয়া উচিত।’
‘সরকারের উচিত একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করে এই পরিকল্পিত হামলা ও ভাঙচুরের পেছনের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা।’-বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনিসুর রহমান সিনহা
বিক্ষোভ চলাকালে দেখা যায়, শ্রমিকদের চেয়ে বহিরাগত ও দুর্বৃত্তের সংখ্যাই বেশি। শ্রমিক অসন্তোষ আগের তুলনায় অস্বাভাবিক ছিল।
‘সরকারের উচিত একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করে এই পরিকল্পিত হামলা ও ভাঙচুরের পেছনের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা’ বলে মন্তব্য করেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনিসুর রহমান সিনহা।
আরও পড়ুন পোশাকের বিদেশি ক্রেতাদের একত্র করে সহযোগিতা চাইবেন ড. ইউনূস বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পোশাক শিল্প, কার্যাদেশ হারানোর শঙ্কা অস্থির শিল্পাঞ্চলে স্বস্তি, কঠোর অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাংলাদেশ থেকে পোশাকশিল্প সরিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছেবিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ‘এবারের শ্রমিক অসন্তোষ ছিল কঠিন ও অপ্রতিরোধযোগ্য। এর পেছনে একটি অলৌকিক শক্তি ছিল। এ ধরনের স্বার্থান্বেষী মহল সক্রিয় থাকলে এ খাত টিকবে না।’
হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, ‘হঠাৎ মারপিট শুরু হয়ে গেলো-ভাঙচুর শুরু হয়ে গেলো। মালিকরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেক কারখানায় লুট হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী না থাকলে আরও অনেক পোশাক কারখানা লুট হয়ে যেতো।’
‘কেউ কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চেষ্টা করছে। শ্রমিকরা আইন ভঙ্গ করলে শ্রমিক নেতাদের দায়িত্ব নিতে হবে। কিছু একটা হলেই বেতন বাড়াতে হবে এমন দাবি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’-বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু
ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এবং কারখানার মালিকরা সঠিক তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
‘কারখানা চলবে এমন না, চলমান থাকতে হবে। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা শ্রম আইন ভঙ্গ করবে তাদের শ্রম আইনের আওতায় বিচার করতে হবে। যারা অপরাধমূলক কাজ করবে তাদের ক্রিমিনাল আইনের অধীনে বিচার করতে হবে’, বলে জানান বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু।
তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চেষ্টা করছে। শ্রমিকরা আইন ভঙ্গ করলে শ্রমিক নেতাদের দায়িত্ব নিতে হবে। কিছু একটা হলেই বেতন বাড়াতে হবে এমন দাবি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’
আরও পড়ুন নোটিশ ছাড়া হঠাৎ পোশাক কারখানা বন্ধ না করার আহ্বান আইবিসির পোশাক শিল্পে অস্থিরতা তৈরি করছে ফ্যাসিবাদের দোসররা কড়া নিরাপত্তায় খুলেছে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ কারখানাশ্রমিকের বেতন নির্ধারণের জন্য ওয়েজবোর্ড আছে এবং সেটা আইন অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পরপর গঠন করা হয়। আইনে ৫ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের কথা বলা আছে। সেটা পালন করা হবে বলে জানান মাহমুদ হাসান খান বাবু।
তিনি আরো বলেন, শ্রম ও আইনের বাইরে কোনো দাবি-দাওয়া থাকলে তার সমাধানের সময় দিতে হবে। হঠাৎ করে কর্ম বন্ধ করা বা ফ্যাক্টরি ভাঙচুর করা কোনো সমাধান নয়।
ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আমিরুল হক আমিন বলেন, শ্রম আইন মালিক-শ্রমিক উভয়কেই মানতে হবে। কোনো শ্রমিক আইন ভঙ্গ করলে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত করা যাবে না।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন জায়গায় নানা দাবি-দাওয়া আদায়ে আন্দোলন শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন শিল্প খাতও এর বাইরে থাকতে পারেনি। গত ৩১ আগস্ট ২১ দফা ও ১৭ দফা দাবিতে গাজীপুরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ও নারায়ণগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেন ফার্মাসিউটিক্যালস কারখানার শ্রমিকরা।
তারা মহাসড়কে আগুন ধরিয়ে দেন। ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার সাভার ও ধামরাইয়ে পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। পরে সেখানকার অন্তত ১৫টি পোশাক কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
শিল্প পুলিশ ও বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, ২ সেপ্টেম্বর শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে তৈরি পোশাক, ওষুধ, খাদ্যসহ বিভিন্ন শিল্পের শতাধিক কারখানার উৎপাদন বন্ধ ছিল। বিক্ষোভ শুরুর পর আশুলিয়ায় ৪০টি ও গাজীপুরে ৪৫টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। গাজীপুরের ১১টি তৈরি পোশাক কারখানায় ভাঙচুর করা হয়। দুটি কারখানায় লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। ৪ সেপ্টেম্বর শ্রমিক বিক্ষোভের ১৬৭টি তৈরি পোশাক কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। অন্তত ২৫টি বড় ওষুধ কারখানায় উৎপাদন বন্ধ ছিল। ৫ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভের কারণে ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার ১২৯টি পোশাক কারখানা বন্ধ ছিল।
আইএইচও/এমএমএআর/জেআইএম