জাতীয়

সরকারি জমি দখল, টেন্ডারবাজিতে ‘ক্লিন ইমেজের’ আইভী

প্রায় ১৩ বছর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। আওয়ামী লীগের আলোচিত নেতা শামীম ওসমানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আইভী খবরের শিরোনাম হয়েছেন একাধিকবার। তবে ক্লিন ইমেজের এই নেত্রীর বিরুদ্ধে রয়েছে প্রকল্পে অনিয়ম, রেলের জমি দখল, জায়গা দখল করে মার্কেট নির্মাণসহ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ। অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগ উঠেছে তার ভাই ও ব্যক্তিগত সহকারীর বিরুদ্ধেও।

Advertisement

তবে আইভীর দাবি, এক টাকার দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে যে কোনো শাস্তি মাথা পেতে নেবেন তিনি।

ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দেশের সবগুলো সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গত ১৯ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানা যায়। একইদিনে আরেকটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এসব সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন আইভীসহ সাবেক দুই এমপির বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু এক নজরে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী এবার নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র আইভীর নামে হত্যা মামলা আমাদের ক্ষমতা সামান্য, চাইলেও অনেক কিছু করতে পারি না

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আইভীর বিরুদ্ধেও তারা দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

Advertisement

টানা তিনবারের মেয়র আইভী

ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ২০০৩ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রথম নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে শামীম ওসমানকে লক্ষাধিক ভোটে হারিয়ে দেশের প্রথম নারী মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৬ ও ২০২২ সালে ফের মেয়র নির্বাচিত হন নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আইভী।

আইভীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মনিরুল ইসলাম নামের একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহতের ঘটনায় সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক এমপি শামীম ওসমান ও সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিরুদ্ধে গত ৩ সেপ্টেম্বর মামলা করা হয়। মামলায় আসামির তালিকায় তার ছোট ভাই মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আহাম্মদ আলী রেজা উজ্জ্বলেরও নাম আছে। উজ্জ্বলকে আরও অন্তত দুটি মামলায় আসামি করা হয়েছে।

দোকান বরাদ্দের নামে কোটি টাকা লোপাট

২০১৯ সালের ১৯ জুন হঠাৎ করে ভেঙে দেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জ শহরের ২ নম্বর রেলগেট এলাকার রহমত উল্লাহ মুসলিম ইনস্টিটিউট ভবন। তিনতলা বিশিষ্ট ভবনটিতে কনফেকশনারি, ফ্রিজ, এসি, সেলাই মেশিন, টেইলার, সুতা, রাবারের দোকানসহ প্রায় ৩৫টি দোকান ছিল।

ইনস্টিটিউট ভেঙে সেখানে করা হয় হাঁটার জায়গা ও পার্ক। পার্কের ১০০ গজ দূরে সিটি করপোরেশনের খোলা জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে রহমত উল্লাহ মুসলিম ইনস্টিটিউট শপিং কমপ্লেক্স।

Advertisement

পুরাতন মার্কেটের ব্যবসায়ী আলাউদ্দিনের অভিযোগ, মার্কেট স্থানান্তর করে ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি বাড়ানো হয়েছে। নতুন মার্কেটে দোকান বরাদ্দের নামে কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। অনেকেই বঞ্চিত হয়েছে।

আরেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, ‘রাস্তা বানানোর কথা বলে আমাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। অথচ বানানো হয়েছে পার্ক। উচ্ছেদের সময় ব্যবসায়ীরা এর প্রতিবাদ করেছিলেন।’

গত ৯ সেপ্টেম্বর পার্কটি ঘুরে দেখা গেছে, ভবঘুরে ও মাদকাসক্তদের দখলে রয়েছে পার্কটি। অন্যদিকে নতুন মার্কেটে তিনতলা পর্যন্ত উঠে দেখা গেছে, দোতলা ও তিনতলার অধিকাংশ দোকানই খালি। পুরো ভবনে ইনস্টিটিউটের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন ‘কোর্ট তুমার বাবার নয়, জনগণের’ মেয়র আইভীকে হেফাজত নেতা এক টেবিলে বসছেন আইভী-শামীম-সেলিম, কথা বলবেন সমস্যা নিয়ে আমি যখন রাস্তায় নামবো তখন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হবে: আইভী নাগরিকরা নয় নারায়ণগঞ্জের ২ এমপি বললেই প্রশাসন কাজ করে: আইভী

এ বিষয়ে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী জাগো নিউজকে বলেন, রেলগেট এলাকার যানজট নিরসনে এ ভবনটি ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেয় সিটি করপোরেশন। পুরাতন ভবন অপসারণ শর্তে ২০০৮ সালে তাদের কিছু দূরেই আরেকটি জমি দেওয়া হয়। কিন্তু ৯ বছর ধরে ব্যবসায়ীরা সরেননি। পরে সিটি করপোরেশন এটি উচ্ছেদ করেছে।

রেলের জমি দখল করে শেখ রাসেল পার্ক

নগরীর দেওভোগ এলাকায় রেলের ১৮ একর জমি দখল করে নয়নাভিরাম শেখ রাসেল পার্ক গড়ে তোলেন আইভী। অভিযোগ আছে, ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে পার্কের কাজ করেছেন তিনি। জমি দখলে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেননি আইভী।

এই অভিযোগ অকপটে স্বীকার করে আইভী জাগো নিউজকে বলেন, ‘শহরের প্রাণকেন্দ্রে রেলের এ জমিটি দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত ছিল। এখানে বস্তি, মাদক ও খোলা ল্যাটট্রিন ছিল। যারাই ক্ষমতায় ছিল, তারাই রেলের এই জায়গা বিক্রি করেছে। আমি সেটা দখল করে বিনোদন কেন্দ্র বানিয়েছি। গরিব মানুষের বাচ্চা-কাচ্চারা এখানে সাঁতার শিখতে পারছে। এতে আমার শাস্তি হলে তা মেনে নেব।’

নারায়ণগঞ্জের হোয়াইট হাউজ

সেলিনা হায়াৎ আইভী থাকেন পশ্চিম দেওভোগ এলাকার সুরম্য অট্টালিকায়। সাদা রঙের অট্টালিকার নাম চুনকা কুটির। অনেকেই এটিকে বলেন, নারায়ণগঞ্জের হোয়াইট হাউজ।

নয়নাভিরাম চুনকা কুটিরের পাশেই রয়েছে তিনতলা বিশিষ্ট খানকাহ শরিফ। স্থানীয়দের দাবি, চুনকা কুটিরের নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৪০ কোটি টাকা।

জানা গেছে, বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করলেও আইভীর আয়কর নথিতে বাড়ি তৈরির কোনো তথ্য নেই। আইভী ২০২০-২০২১ করবর্ষে যে তথ্য দিয়েছেন তাতে উল্লেখ রয়েছে, তার মোট অর্জিত তহবিল ১৯ লাখ ৬৮ হাজার টাকা ও নিট সম্পদ ২৩ লাখ ৭২ হাজার ২৫০ টাকা। এছাড়া পৈতৃক সূত্রে পেয়েছেন ১২ শতাংশ জমি।

২০২১ সালে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় আইভী উল্লেখ করেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সম্মানী ছাড়া তার এখন কোনো আয়ের উৎস নেই। নাসিক মেয়র হিসেবে তিনি বছরে ১৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা সম্মানী পান। তার কাছে বর্তমানে আছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৪০১ টাকা। আর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার নামে জমা আছে ২৩ লাখ ৮২ হাজার ৯০৫ টাকা। স্বর্ণ ও অলংকার আছে ৩০ হাজার টাকা মূল্যের। এছাড়া তার আর কোনো সম্পদ নেই। কোনো ব্যাংক ঋণ নেই।

এ বিষয়ে আইভী বলেন, ‘এই বাড়ি আমার না। এটা আমার বাবার (স্বাধীনতার পর নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম মেয়র প্রয়াত আলী আহাম্মদ চুনকা) পৈতৃক সম্পত্তি। খানকাহ শরিফ আমার বাবা দান করে গেছেন। এই বাসা করতে গিয়ে প্রায় ৫ থেকে সাড়ে ৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এটা একটা চারতলা বাড়ি।’

এছাড়া আইভী নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী চিত্তবিনোদন ক্লাব ভেঙে মার্কেট নির্মাণ করে কোটি কোটি টাকার দোকান বরাদ্দ বাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ আছে। আইভী ও তার সহযোগীদের একাধিক ব্যাংক হিসাবে লোপাটের টাকা আছে।

এ বিষয়ে আইভী বলেন, ‘জনতা ব্যাংকে আমার একটা অ্যাকাউন্ট আছে। ওই অ্যাকাউন্টে বেতন বাবদ ৬-৭ লাখ টাকা আছে। যেটা দিয়ে আমি ৩-৪ মাস চলতে পারবো। এরপর কী হবে জানি না। হয়তো আমাকে চাকরি খুঁজতে হতে পারে। আমিসহ আমার সহযোগীদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, সেগুলো তদন্ত হোক।’

আইভীর দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ

আইভীর দুই ভাই আলী রেজা রিপন ও আহাম্মদ আলী রেজা উজ্জ্বল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সিদ্ধিরগঞ্জ অঞ্চলে কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ ও অপসারণ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, ধলেশ্বরী নদী পর্যন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শোভাবর্ধন প্রকল্প, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত পাইকপাড়া মিউডুয়েল ক্লাব পুনর্নির্মাণ প্রকল্প, কদমরসুল অঞ্চলে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি লোপাট করেছেন বলে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ব্যক্তিগত সহকারীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ

অভিযোগ আছে, মেয়রের দায়িত্ব পালনকালে সেলিনা হায়াৎ আইভীর ব্যক্তিগত সহকারী আবুল হোসেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বিভিন্ন সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে চাঁদাবাজি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার নামে নারায়ণগঞ্জ মহানগরেই রয়েছে ৪-৫টি ফ্ল্যাট, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা।

জানা গেছে, আইভীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে আরিফ হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হলেও তাকে সংশ্লিষ্ট পদে পদায়ন না করে একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে পদায়ন করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে আইভীর ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন আবুল হোসেন।

বাদ যাননি আইভীর গাড়িচালকও

দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন আইভীর গাড়িচালক মো. বিল্লাল হোসেনও। নারায়ণগঞ্জ মহানগরে বরফ কল ও পানির কল এলাকায় প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের প্রতিটি কাজ ই-টেন্ডারের মাধ্যমে অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে দুদক ও স্থানীয় সরকার বিভাগ এর আগেও অনুসন্ধান করেছে। তারা আমাকে ক্লিন চিট দিয়েছে। যেসব অভিযোগ এখন আসছে, এগুলো আসলে ২০২১ সালে নাসিক নির্বাচনের আগে ওসমান সাহেব দুদকে করেছেন। দুদক স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান করতে পারে।’

পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে আইভী বলেন, ‘পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। এই কাজটা আমি কখনোই করিনি। একমাত্র প্রতিষ্ঠান নাসিক যেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব ধরনের লোক কাজ করতে পেরেছে।’

এসএম/এমএমএআর/জিকেএস