খোয়াবনামা উপন্যাস নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে এটা রচনার প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা জরুরি যেখান থেকে আমি আসলে উপন্যাসটা পড়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম। আহমদ ছফা তার ‘খোয়াবনামা উপন্যাস’ প্রবন্ধে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বরাত দিয়ে বিস্তারিত লিখেছিলেন।
Advertisement
একবার কলকাতাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্যোগে সাহিত্যের গতিপ্রকৃতির ওপর একটা সেমিনারে তিনি কাটাকটা ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষা হবে দেশের জনগণের মুখের ভাষার কাছাকাছি, তাতে করে যদি পশ্চিম বাংলার ভাষার চাইতে বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষা, বিশেষ করে উপন্যাসের ভাষা সম্পূর্ণ একটা আলাদা খাতে প্রবাহিত হয়ে যায়, সেটা সকলের স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া উচিত।’
ইলিয়াস সাহেবের সোজাসাপ্টা এই দর্পিত উচ্চারণ পশ্চিম বাংলার সাহিত্যের মোড়লদের যে ভালো লাগেনি সেই সন্ধ্যাবেলাতেই তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের ডিনারে ইলিয়াসকে আর ডাকেনি। এরপরই তিনি দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন বাংলাদেশের উপন্যাসের ভাষা কীভাবে বাংলাদেশের মানুষের মুখের ভাষার অনুবর্তী হয় তার একটা দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করবেন। মূলত সেই সংকল্প থেকেই ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসটি রচনার পরিকল্পনা তার মাথায় আসে। খোয়াবনামা উপন্যাসটির জন্য যে সময়সীমাটি তিনি ছকিয়ে নিয়েছিলেন, আধুনিক বাঙালি জাতির বিকাশের জন্য এই সময়টির গুরুত্ব অপরিসীম।
মূল আলোচনায় ফেরা যাক। খোয়াবনামা উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা সবাই তাদের আঞ্চলিক ভাষায় কথাবার্তা বলেন। এছাড়াও এই উপ্যান্যাসে ব্যবহৃত হয়েছে পুঁথির শ্লোক। এইসব মুসলমানী পুঁথিসমূহ বাঙালি মুসলমানের পশ্চাৎপদ মানসিকতার পরিচয় চিহ্ন ধারণ এবং বহন করে। ইলিয়াস ভাষা বিষয়ক ডিসকোর্স ছাড়াও রাজনৈতিক ডিসকোর্সের অবতারণা করেছেন। তিনি তখনকার সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে কংগ্রেস, মুসলিমলীগ, হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের প্রক্রিয়াটিকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। এছাড়াও তেভাগা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের শোষিত মানুষের কথাও বলেছেন।
Advertisement
উপন্যাসটি মূলত বঙ্গভঙ্গ অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের কিছুদিন পূর্ব এবং পরবর্তী সময়কাল নিয়ে রচিত। এর কাহিনী বিস্তৃতিলাভ করেছে বগুড়া জেলার একটি ক্ষুদ্রাকার ও প্রত্যন্ত জনপদে। অঞ্চলটির কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিল, যার নাম কাৎলাহার। বিলটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা জনপদ গিরিরডাঙা, নিজগিরির ডাঙা, গোলাবাড়ি ইত্যাদি। এখানে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বিষয়ক বিভিন্ন শ্রুতি বা লোককথার পাশাপাশি জোতদারি সমাজব্যবস্থা, তেভাগা আন্দোলন, দেশভাগ ও মুসলিম লীগের রাজনীতি, হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক ও সংকট প্রবৃত্তি এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। কাহিনির প্রয়োজনে এবং বাস্তবতার নিরিখে এতে আরও যুক্ত হয় সাধারণ গ্রাম্য মানুষের অসহায়ত্ব, কাম, ক্ষোভ, ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ।
বইটির ফ্ল্যাপের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক, যেখান থেকে আমরা উপন্যাসটির কাহিনী সম্মন্ধে ধারণা পাবো। মেলা দিন আগেকার কথা। কাৎলাহার বিলের ধারে ঘন জঙ্গল সাফ করে সোভান ধুমা আবাদ শুরু করে বাঘের ঘাড়ে জোয়াল চাপিয়ে। ওইসব দিনের এক বিকালবেলায় মজনু শাহের অগুনতি ফকিরের সঙ্গে মহাস্থান গড়ের দিকে যাবার সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেপাই সর্দার টেলারের গুলিতে মারা পড়ে মুনসি বয়তুল্লা শাহ।
কাৎলাহার বিলের দুই ধারের মানুষ সবাই জানে, বিলের উত্তরে পাকুড়গাছে আসন নিয়ে রাতভর বিল শাসন করে মুনসি। দূরে কোথাও ভূমিকম্প হলে যমুনা বদলে যায়। বন্যায় ভেঙে পড়ে কাৎলাহারের তীর। মুনসির নিষ্কণ্টক অসিয়তে চাষীরা হয় কাৎলাহার বিলের মাঝি।
খোয়াবনামার শুরু। বিলের মালিকানা চলে যায় জমিদারের হাতে। মুনসির শোলোকে শোলোকে মানুষের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে বেড়ায় চেরাগ আলি ফকির। তমিজের বাপ শোলোক শুনে আর ঘুমের মধ্যে বিলে গিয়ে কাদায় পা ডুবিয়ে দেখতে চায় পাকুড়গাছের মুনসিকে। ভবানী পাঠকের সঙ্গে পূর্বপুরুষের জের টেনে বৈকুণ্ঠনাথ গিরি প্রতীক্ষা করে ভবানীর শুভ আবির্ভাবের। তমিজ দেখে জমির স্বপ্ন। আর চেরাগ আলির নাতনি কুলসুম খোয়াভে কার কায়া যে দেখতে চায় তার দিশা পায় না। তেভাগার কবি কেরামত শেষ পর্যন্ত আটকে পড়ে শুধুই নিজের কোটরে; সে নাম চায় বৌ চায় ঘর চায়।
Advertisement
কোম্পানির ওয়ারিশ ব্রিটিশের ডাণ্ডা উঠে আসে দেশি সায়েবদের হাতে। দেশ আর দেশ থাকে না, হয়ে যায় দুটি রাষ্ট্র। দেশি সায়েবরা নতুন রাষ্ট্রের আইন বানায়, কেউ হয় টাউনবাসী, কেউ হয় কন্ট্রাকটর। আবার নিজদেশে পরবাসী হয় কোটি কোটি মানুষ। হিন্দু জমিদার নায়েব চলে যাওয়ার পরও আজাদ পাকিস্তানে জমি আর বিলের মানুষ নিজেদের মাটি আর পানির পত্তন ফিরে পায় না। পাকুড়্গাছ নাই। মুনসির খোঁজ করতে করতে চোরাবালিতে ডুবে মরে তমিজের বাপ। ভবানী পাঠক আর আসে না। বৈকুণ্ঠ নিহত।
ক্ষমতাবান ভদ্রলোকের বাড়িতে চাকর হয়ে বিল ডাকাতির আসামি তমিজ পুলিসকে এড়ায়। কিন্তু তার কানে আসে কোথায় কোথায় চলছে তেভাগার লড়াই। নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে তমিজ বেরিয়ে পড়ে তেভাগার খোঁজে। ফুলজানের গর্ভে তমিজের ঔরসজাত মেয়ে সখিনাকে নিয়ে ফুলজান ঠাঁই নেয় কোথায়! খোয়াবনামা সারা। কিন্তু মোষের দিখিরপাড়ে শুকনা খটখটে মাঠের মাটিতে দাঁড়িয়ে কাৎলাহার বিলের উত্তরে সখিনা দেখতে পায় জ্বলন্ত হেঁসেলে বলকানো ভাত। খোয়াবনামার জিম্মাদার তমিজের বাপের হাত থেকে খোয়াবনামা একদিন বেহাত হয়ে গিয়েছে। এখন সখিনার খোয়াব। খোয়াবনামা স্বপ্নের ব্যাখ্যাতা। কিন্তু স্বপ্নের ব্যাখ্যায় যা বিবেচ্য তা স্বপ্ন নয়, স্বপ্নদেখা মানুষ।
এই উপন্যাসে গ্রামীণ লোকবিশ্বাসের সফল প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। কথাসাহিত্যিক শওকত আলী তার ‘খোয়াবনামা-র মিথ: তৃণমূলে যাবার এক পথ’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখেন যে, ‘পুরো খোয়াবনামা মনোযোগ দিয়ে পড়ার পর যে কোনও পাঠকের মনে হবে যে, এ রচনা আলাদা। মাটি মানুষ বিল ঝিল নদী জঙ্গল জন্ম মৃত্যু প্রেম লোভ ঘৃণা দ্বন্দ্ব ইত্যাদি মানবিক ও প্রাকৃতিক বিষয়,
প্রসঙ্গ, আবহ, অতীত আর বর্তমানের সঙ্গে এমনভাবে মেশামেশি হয়ে রয়েছে যে এর পুরো ব্যাপারটা যতখানি-না বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করে বুঝবার, তার চাইতে অনেক বেশি সরাসরি উপলব্ধি করার।’ এটা খুবই সত্যি কথা এবং আমার ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছে। উপন্যাসের পরিবেশটা আমার চেনা থাকাতে ঘটনাগুলো আমি মনপ্রাণ দিয়ে অনুভব করেছি যার প্রভাব থাকবে আজীবন।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনাসমগ্র দুই এর ভূমিকায় খালিকুজ্জামান ইলিয়াস লিখেছেন, ‘খোয়াবনামার একটি অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বৈকুণ্ঠ গিরি। বৈকুণ্ঠের যুক্তি সহজ’। যদি দুই সম্প্রদায় ‘একত্তরই হয়' তাহলে মুনসি ভবানীর কথা শুনবে না কেন? এজন্য তার বক্তব্যে হয়তো অজ্ঞাতেই আলি হয়ে যায় ভবানীর শক্তি, কালি মজনুর। দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একজোট হলে তাদের সব কিছুই অভিন্ন হয়ে পড়ে তখন দেবদেবীর হস্তান্তর হতে আপত্তি কি?
‘এভাবে গণঅবচেতনের একেবারে তলানি ছেনে ইলিয়াস দেখিয়েছেন যে সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিই কাম্য, বিভাজন নয় এবং সাধারণ মানুষ তাদের দিনকে দিনের ক্ষুদ্র বৃহৎ রেষারেষি সত্ত্বেও গভীর অবচেতনে মূলত অসাম্প্রদায়িক। খোয়াবনামার বহু সাফল্যের ভেতর সাম্প্রদায়িক মেলবন্ধনের এই শিল্পসম্মত চিত্রও একটি।’
রাজনীতি আমাদের জীবনের একটি প্রধান নিয়ামক হলেও আমাদের সাহিত্যে সরাসরি রাজনৈতিক প্রসঙ্গ ব্যাপকভাবে বিবেচিত হয়নি বললেই চলে। রাজনীতির সঙ্গে লেখকরা সবসময়ই যেন কিছুটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছেন। সম্ভবত ইলিয়াসই প্রথম এতোটা সার্থক শিল্পসম্মতভাবে রাজনীতিকে তাঁর উপন্যাসে ধারণ করলেন। ঔপন্যাসিক ইতিহাস লেখেন না, ইলিয়াসও লেখেননি।
ইতিহাস ও লোকশ্রুতির এক আশ্চর্য মিশ্রণ আমরা লক্ষ্য করি তার রচনায়। মিথের ব্যবহার ও পুনর্নির্মাণে তার দক্ষতা তাকে একজন বড়মাপের সাহিত্যিকের পর্যায়ভুক্ত করেছে। সমগ্র বাংলা সাহিত্যের পটভূমিতে বিচার করলেও ইলিয়াসের এ সাফল্য অতুলনীয়। আর এদিক থেকে তিনি আমাদের সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের অগ্রযাত্রায় শামিল করেছেন।
এমআরএম/এএসএম