জাতীয়

প্রতিবাদের গল্পগুলো আঁকা থাক দেওয়ালে দেওয়ালে

রং-তুলির আঁচড়ে ফুটে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা। দেওয়াল লিখন আর গ্রাফিতিতে সেজেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালগুলো। কোথাও স্বৈরাচারী শাসকের ভয়ানক থাবার কথা, কোথাও বা বেদনাবিস্মৃত দুঃসহ স্মৃতির কথা। যে কেউ পাশ কেটে গেলে চোখে ভেসে উঠবে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের সরকার পতনের ইতিহাস।

Advertisement

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভেতরে বিভিন্ন ভবনের দেওয়াল আর সীমানা প্রাচীরে এক সময় দেখা যেত সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন অথবা বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক বক্তব্য, স্লোগান লেখা। এসবের মাধ্যমে তারা দলীয় আদর্শ প্রচার করতো। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন ছাত্রদল এবং গত সাড়ে ১৫ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব দেওয়াল দখল করে নিয়েছিল ছাত্রলীগের দলীয় স্লোগান। সেসবের আর বালাই নেই।

আমরা তখন যে গ্রাফিতি ও দেওয়াল লিখনগুলো করেছিলাম সেগুলো ছিল তাড়াহুড়ো করে করা। সবসময় একটা ভয় কাজ করতো। ৫ আগস্টের আগে পুলিশ, ছাত্রলীগের হামলার ভয় নিয়েই গ্রাফিতি করা।-ঢাবি শিক্ষার্থী বদিউল হক

৫ আগস্টের আগেও হয়তো অনেকের কল্পনায়ও ছিল না, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকা শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদরাসার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাস্তায় নেমেছিলেন লাখ লাখ জনতা। পুরো দেশ যেন একাট্টা হয়েছিল স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাতে। অবশেষে ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনার সরকারের। সেদিনই পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা।

Advertisement

আওয়ামী সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্ণ হলো গত ৮ সেপ্টেম্বর। এই এক মাসে প্রতিটি সেক্টরে পরিবর্তন আর সংস্কারের আভাস মিলছে। সেই পরিবর্তনের আন্দোলনে থেমে নেই শিক্ষার্থীরা। ৫ আগস্টের পর দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে দায়িত্ব নেন শিক্ষার্থীরা। সামাল দিয়েছেন সড়ক-মহাসড়কে যান চলাচল। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেছেন পুরো রাজধানী। পাশাপাশি তারা হাত দেন দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি আঁকার কাজে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ যে কোনো স্থাপনার দেয়ালজুড়ে শোভা পাচ্ছে তাদের আঁকিবুঁকি।

কী লেখা শোভা পাচ্ছে দেয়ালে দেয়ালে

গত আগস্টের শুরুতেই আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রলীগ ও বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর লেখা দেয়াল লিখন মুছে ফেলে। তারপর সেখানে প্রতিবাদী কবিতা, গান কিংবা আন্দোলনের বিভিন্ন স্লোগান লেখা শুরু করেন। ওই সময়ের দেয়াল লিখনগুলো অধিকাংশই ছিল তাড়াহুড়ো করে লেখা।

গ্রাফিতির মাধ্যমে একদিকে যেমন রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত জুলাই-আগস্ট মাসের স্মৃতি মনে পড়ছে, তেমনি সময়ের ব্যবধানে মানুষের মন থেকে জুলাই বিপ্লবের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির রোমন্থনও হচ্ছে।-ঢাবি শিক্ষার্থী তাসলিমা আনজুম

৫ আগস্টের আগের দেয়াল লিখনগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ ছিল ‘দফা এক দাবি এক-খুনী হাসিনার পদত্যাগ’, ‘রক্তচোষা হাসিনা’, ‘স্টেপডাউন হাসিনা’, ‘আর কত রক্ত লগবে?’, ‘চাকরি না দিবু না দে, আমার ভাইয়েক মারলু ক্যানে?’ এ ধরনের আরও অনেক কিছু।

Advertisement

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বদিউল হক বলেন, ‘আমরা তখন যে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখনগুলো করেছিলাম সেগুলো ছিল তাড়াহুড়ো করে করা। সবসময় একটা ভয় কাজ করতো। ৫ আগস্টের আগে পুলিশ, ছাত্রলীগের হামলার ভয় নিয়েই গ্রাফিতি করা হতো। বেশিরভাগ সময় কোনো মিছিল যাচ্ছে, মিছিলে চলতি অবস্থায় দ্রুত একটা স্লোগান লিখে চলে গেলাম। এমন হওয়ার কারণে ওই সময়ের লিখনগুলো ততটা সুশ্রী হতো না। তবে সেই লেখায় বিপ্লবের একটা ছাপ লক্ষ্য করা যেত।’

তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বদলে গেছে দেয়ালগুলোর চিত্র। এখন দেয়ালগুলোতে শোভা পায় কোটা আন্দোলন থেকে শুরু করে গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত নানারকম স্মৃতিচিহ্ন। বিভিন্ন আর্ট স্কুলের শিক্ষার্থীরা ৮-১০ দিন ধরে রাঙিয়ে তোলেন এসব দেয়াল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলোতে আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ হবার সময় বুক পেতে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য, মুগ্ধের ভাইরাল হওয়া, পানি লাগবে কারও পানি? এমন বাক্য, ৩৬ জুলাইয়ের ক্যালেন্ডার, শেখ হাসিনার প্রতিকৃতিসহ আরও বিভিন্ন ধরনের স্লোগান লেখা আছে।

আরও পড়ুন ঐতিহাসিক ৫ আগস্টে যা যা ঘটলো  পরিচয়পত্রটি তার পকেটে ছিল রক্তে ভেজা  ‘আমাকে আর কেউ চাকরি দেবে না, বলবে তোর পা নেই’  পুলিশ ৬টা গুলি করে, এরপর ৩ তলায় পড়ে যাই  যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন চোখে গুলি লেগে আহতরা 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসলিমা আনজুম বলেন, ‘এসব গ্রাফিতির মাধ্যমে একদিকে যেমন রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত জুলাই-আগস্ট মাসের স্মৃতি মনে পড়ছে, তেমনি সময়ের ব্যবধানে মানুষের মন থেকে জুলাই বিপ্লবের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির রোমন্থনও হচ্ছে।’

তাসলিমা আনজুম বলেন, ‘আমরা একটা রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে গেছি খুব বেশিদিন হয়নি। কিন্তু এরইমধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারসহ নানান কাজে আমাদের ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। আমরা যখন নানান কাজের চাপে পড়ে সবকিছু থেকে একটু দূরে সরে যাই, ঠিক তখন আবার ক্যাম্পাসে ফিরে দেয়ালের এই লেখাগুলো কিংবা কাঁচা হাতের আঁকা এই গ্রাফিতিগুলো দেখি তখন আবারো আমাদের অভ্যুত্থানের স্পিরিট ফিরে পাই। হাজারো শহীদের কথা তখন আবার মনে পড়ে, আমাদের দেশকে আমাদেরই গড়তে হবে। আমাদের দেশের মস্তক বিশ্বের দরবারে আমরাই সমুন্নত রাখবো।’

অনেকে মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে এই দেয়ালগুলোতে দলীয় স্লোগান না লিখে শিক্ষণীয় বিষয় লিখলে সেটি বেশি ভালো হয়। যেমন, বিখ্যাত কোনো ব্যক্তির বাণী, শিক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন বাণী প্রভৃতি।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা মুক্তচিন্তা চর্চার কেন্দ্র উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা বলছেন, সারাদেশে কী হবে এটা অনেকটা নির্ভর করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হচ্ছে সেটার ওপর। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে গণ-অভ্যুত্থানের চিত্রই এখন উপযুক্ত। কেবল এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই দলমত নির্বিশেষে সবাই এক হতে পেরেছে।

এমএইচএ/এসএনআর/এমএমএআর/জিকেএস