জাতীয়

হাত ধোয়ার জন্য ফের ২০ কোটি টাকা আবদার!

হাত ধোয়াকে প্রাধান্য দিয়ে এর আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুটি প্রকল্প অনুমোদন হয়। তিন বছর না যেতেই ফের একই খাতে প্রকল্পের আওতায় ২০ কোটি টাকা আবদার করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ধরনের প্রকল্প বারবার পাঠানোর কারণে প্রশ্ন তুলে হাত ধোয়ার অংশ বাদ দিতে বলেছে কমিশন। একই সঙ্গে আগে বাস্তবায়িত দুটি প্রকল্পের খবরও জানতে চাওয়া হয়েছে।

Advertisement

নতুন করে সরকারি স্কুল ফিডিং কর্মসূচি (ফেজ-১) প্রকল্পের আওতায় হাত ধোয়ার নামে ২০ কোটি টাকার আবদার করা হয়। প্রকল্পের মোট প্রস্তাবিত ব্যয় ৪ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা। জুলাই ২০২৪ থেকে জুন ২০২৭ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।

২০ কোটি চাইলেই আমরা দিয়ে দেবো না। যৌক্তিকভাবে চাইতে হবে। যদি লজিক্যালি দেখা যায় সঠিক আছে তখনই অনুমোদন। তার আগে প্রতিটা ব্যয় ধরে ধরে দেখবো। তারা যেভাবে ২০ কোটি চাইছে সেভাবে নাও দেওয়া হতে পারে।- সচিব রেহানা পারভীন

এর আগে হাত ধোয়াকে প্রধান্য দিয়ে ২০২১ সালে ‘কোভিড-১৯ মোকাবিলায় হাইজিন’ প্রকল্পে ৩২৬ কোটি ও ২০২০ সালে ‘মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি’ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৮৮৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়। তিন বছর না যেতেই একই কাজ করতে ২০ কোটি টাকা চাওয়া হলো।

Advertisement

প্রকল্পের উদ্দেশ্য

দেশের দরিদ্রপ্রবণ এলাকাগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে পাঁচদিন পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এই ‘স্কুল ফিডিং’ কর্মসূচির আওতায় শিক্ষার্থীদের দুধ, ডিম, মৌসুমি ফল, কলা, ফর্টিফাইড বিস্কুট, কেক ও বনরুটি দেওয়া হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের ১৫০ উপজেলার ১৮ থেকে ১৯ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।

কমিশনের পর্যবেক্ষণ

এরই মধ্যে প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় পরিদর্শন ও ভ্রমণের নামে অহেতুক দুটি খাত দেখিয়ে ২০ কোটি টাকা করে ৪০ কোটির প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ দুটি খাত একই হিসেবে গণ্য করে ২০ কোটি টাকার প্রস্তাব করেছে কমিশন। প্রকল্পের আরও কতিপয় খাতের ব্যয় ধরা নিয়েও কমিশন প্রশ্ন তুলেছে। হাত ধোয়ার নামে ২০ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। কীভাবে স্যানেটারি দ্রব্যাদি কিনবে, কোথা থেকে কিনবে, দাম কী হবে তাও উল্লেখ নেই। এজন্য ২০ কোটি টাকার আবদার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। বাচ্চারা কীভাবে হাত ধোবে তার ফরম্যাট, দেশীয় ফরম্যাটে কীভাবে হাত ধোয়ার কাজ পরিচালনা করা যায় সে বিষয়েও মত দিয়েছে কমিশন।

আরও পড়ুন পরিকল্পনামন্ত্রীর এলাকা-শেখ পরিবারের নাম থাকলেই প্রকল্প ‘অটোপাস’ সাবেক এমপিদের প্রকল্প বন্ধ করে ২২৫৭ কোটি টাকা সাশ্রয়! নিম্নমানের মালামাল, ৯২ কোটির ডাক ভবন তিন বছরেই বেহাল খালপাড়ে গাছ লাগানোর নামে ‘পুকুর চুরি’

সম্প্রতি প্রকল্পটি নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা করে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ। বিভাগের সদস্য (সচিব) রেহানা পারভীনের সভাপতিত্বে এ সভা হয়।

হাত ধোয়ার কাজে ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া প্রসঙ্গে সচিব রেহানা পারভীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০ কোটি চাইলেই আমরা দিয়ে দেবো না। যৌক্তিকভাবে চাইতে হবে। যদি লজিক্যালি দেখা যায় সঠিক আছে তখনই অনুমোদন। তার আগে প্রতিটা ব্যয় ধরে ধরে দেখবো। তারা যেভাবে ২০ কোটি চাইছে সেভাবে নাও দেওয়া হতে পারে।’

Advertisement

পরিদর্শন ও ভ্রমণ ব্যয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা একই জাতীয় বিষয়ে বারবার ব্যয় ধরবো না। যেটা যৌক্তিকতা নেই সেটা বাদ দেবো। এজন্য ডিপিপি সংশোধন করতে বলেছি।’

আগের দুই হাত ধোয়া প্রকল্প

তিন বছর আগে শুরু হওয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল (ডিপিএইচই)। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ঠেকাতে হাত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা গুরুত্বপূর্ণ। আর এ হাত ধোয়া কেন্দ্র করেই নতুন নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়। করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশেষত হাত ধোয়া এবং আচরণগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মাধ্যমে টেকসই স্বাস্থ্যাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য ৩২৬ কোটি ৫৯ লাখ ২০ হাজার টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়।

এর মধ্যে ৪০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা সরকারের। বাকি ২৮৬ কোটি ১১ লাখ টাকা উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ। প্রকল্পের লক্ষ্য- প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিশেষত স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন ধরনের হাত ধোয়ার বেসিন স্থাপনের মাধ্যমে কমিউনিটি পর্যায়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও সংক্রামক রোগের সংক্রমণ কমিয়ে আনা। স্বাস্থ্যবিধি চর্চার মানোন্নয়নে গণমাধ্যমের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা।

হাত ধোয়ার কিছু ইউনিট চলমান। তবে কিছু কাজ করছে না। জনবহুল এলাকায় দেখা যায় ট্যাপসহ নানা যন্ত্রপাতি খুলে নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। হয়তো অল্প টাকায় ট্যাপগুলো মেরামত করলে এগুলো পুনরায় চালু করা সম্ভব। তবে স্কুলসহ প্রতিষ্ঠানেরগুলো ঠিক আছে।- ডিপিএইচইর নির্বাহী প্রকৌশলী (ফেনী) মো. শফিউল হক

২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি’ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা।

ডিপিএইচই সূত্র জানায়, প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হয়। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে- পানি সরবরাহসহ বিভিন্ন হাসপাতাল, বস্তি, কমিউনিটি ক্লিনিক ও জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় ১২ হাজার ৪০০টি হাত ধোয়ার সুবিধা স্থাপন করা। এছাড়া হাইজিন কিট, ব্লিচিং পাউডার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশ, পানি পরিশোধন ট্যাবলেট ইত্যাদি কেনা ও সরবরাহ করা হয়। হাত ধোয়ার ইউনিটগুলো কী অবস্থায় আছে, কেমন আছে তা জানা নেই সংশ্লিষ্টদের।

হাত ধোয়ার ইউনিটগুলোর খবর জানতে চাইলে ডিপিএইচই-এর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পানিসম্পদ) মো. জহির উদ্দিন দেওয়ান জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাত ধোয়ার ইউনিটগুলো কেমন আছে বা আদৌ আছে কি না আমার জানা নেই।’

তবে ডিপিএইচইর নির্বাহী প্রকৌশলী (ফেনী) মো. শফিউল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাত ধোয়ার কিছু ইউনিট চলমান। তবে কিছু কাজ করছে না। জনবহুল এলাকায় দেখা যায় ট্যাপসহ নানা যন্ত্রপাতি খুলে নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। হয়তো অল্প টাকায় ট্যাপগুলো মেরামত করলে এগুলো পুনরায় চালু করা সম্ভব। তবে স্কুলসহ প্রতিষ্ঠানেরগুলো ঠিক আছে।’

কমিশনের আরও যত প্রশ্ন

হাত ধোয়া ছাড়াও নানা বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আলোচ্য প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত ১৫০টি উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখসহ শিক্ষার্থীরা যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবে তার বিস্তারিত তথ্য থাকা দরকার। শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার বিতরণ ব্যবস্থাপনা ব্যয় (ভেন্ডর, গোডাউন, পরিবহন, সার্ভিস চার্জ, খাদ্য বিতরণ, প্যাকেজিং ফি) কীভাবে পরিচালিত হবে সে বিষয়ে সভাও প্রকল্পে নেই। ১৫০টি অফিস ভাড়ার জন্য ১০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অফিস ভাড়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখসহ এ খাতের ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তি সম্পর্কে জানতে হবে। দায়িত্ব ভাতা খাতে ১৫৯ জনের বিপরীতে ৪ কোটি ৪ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের মতামত সম্পর্কে জানা প্রয়োজন বলে জানায় কমিশন।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩৫ লাখ শিক্ষার্থীকে সপ্তাহে পাঁচদিন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবার পরিবেশন করা হবে। সব স্কুলে দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত টিফিন টাইম চলাকালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এসব খাবার বিতরণ করা হবে। তবে এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প আগে অনুমোদন না হওয়ায় নতুনভাবে নেওয়া এ প্রকল্প নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে কমিশন। সবকিছু ঠিক থাকলেই প্রকল্পটি একনেক সভায় তোলা হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ড. মো. আতাউল গনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্প নিয়ে আমরা পরিকল্পনা কমিশনে সভা করেছি। কমিশন চাচ্ছে হাত ধোয়ার খাত বাদ দিতে। দরকার হয় বাদ দেবো। এছাড়া ইন্সপেকশনও রাখবো না। তবে ভিজিটে কিছু টাকা রাখবো। পরিকল্পনা কমিশন যেভাবে বলবে সেভাবেই আমরা ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) সংশোধন করবো।’

এমওএস/এএসএ/এএসএম