যে কোনো দুঃসময়, দুর্যোগে সবার কণ্ঠে বেজে ওঠে ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ গানটি। ক্রান্তিকালে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উদ্দীপনামূলক এই গান শোনেননি বাংলা ভাষাভাষী এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। মানুষের সাহায্যে পাশে থাকার এমন আকুল করা গানের শিল্পী ভূপেন হাজারিকা। সংগীতপ্রেমীরা তাকে ‘মানবতাবাদী শিল্পী’ বলতে ভালোবাসেন। ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার শ্রোতা জরিপে তার গাওয়া ‘মানুষ মানুষের জন্যে’ গানটি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশটি বাংলা গানের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ছিল।
Advertisement
আজ (৮ সেপ্টেম্বর) উপমহাদেশের কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী ভূপেন হাজারিকার ৯৯তম জন্মদিন। ভারতের আসামের সাদিয়াতে ১৯২৬ সালের আজকের দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই আসামের লোকগান নিজের ভেতর ধারণ করতেন এই শিল্পী। গানগুলো গাইতেও পছন্দ করতেন তিনি।
ভূপেন হাজারিকার শিক্ষাজীবন হয় শুরু আসামের সোনারাম, তেজপুর, ধুবড়ি এবং বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫২ সালে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। মানবতাবাদী এ শিল্পী মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জন্য কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন গান। ‘জয় জয় নবজাত বাংলাদেশ, জয় জয় মুক্তিবাহিনী’ গানটি অনেকেরই শোনা। তার কণ্ঠে এ গানটি সে সময় ভীষণ উদ্দীপনা যুগিয়েছিল সদ্যস্বাধীন বাংলার মানুষকে। সেই থেকে তিনি এদেশের মানুষের আত্মার মানুষ হয়ে যান। তার এ অবদান মনে রেখে বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০১১ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধ পদক’ প্রদান করে।
দরাজ কণ্ঠের অধিকারী ভূপেন হাজারিকার জনপ্রিয়তা ছিল এক কথায় আকাশছোঁয়া। তিনি অসমীয়া চলচ্চিত্রে সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে গানের ভুবনে যাত্রা শুরু করেন। এরপর তিনি বাংলা ও হিন্দি ভাষায় গান গেয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
Advertisement
ভূপেন হাজারিকার গাওয়া গানের বাণী ও বিষয়বৈচিত্র্যে বহুমুখী। আজীবন মানবতাবাদী, সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন বলেই হয়তো মানবপ্রেম তার গানের মূলকথা হিসেবে ধরা দিয়েছে। এ শিল্পীর গানের মধ্যে মানবিকতা, দেশপ্রেম ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা ফুটে উঠেছে। ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ ছাড়াও ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি, ছুটে ছুটে আয়’ ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’, ‘শরৎ বাবু, খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে’, ‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনাতে নজরুল’, ‘আমায় একজন সাদা মানুষ দাও, যার রক্ত সাদা’ গানগুলো সাম্প্রদায়িকতার ওপরে উঠে কথা বলে।
ভূপেন হাজারিকার উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি গান হলো ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি’, ‘আমি এক যাযাবর’, ‘আমায় ভুল বুঝিস না’, ‘একটি রঙিন চাদর’, ‘ও মালিক সারা জীবন’, ‘গঙ্গা আমার মা’, ‘প্রতিধ্বনি শুনি’, ‘সাগর সঙ্গমে’, ‘হে দোলা হে দোলা’, ‘চোখ ছলছল করে’, ‘মেঘ থমথম করে’।
ভূপেন হাজারিকা সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘ভারত রত্ন’সহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে, ‘পদ্মভূষণ’, ‘পদ্মশ্ৰী’, ‘অসম রত্ন’, ভারতের ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’, ‘অল ইন্ডিয়া ক্রিটিক অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার’, ‘শঙ্করদেব পুরস্কার’, ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’, এশিয়া প্যাসিফিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে রুদালী সিনেমার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।
এমএমএফ/আরএমডি/এমএস
Advertisement