দেশজুড়ে

চাহিদামতো টাকা না পেলেই মামলার আসামি করতেন ওসি খায়ের

চাহিদামতো টাকা না দিলেই করা হতো মামলার আসামি। হয়রানির শিকার হতেন ব্যবসায়ীরা। হোটেলে খেয়ে, দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনে অনেক সময় টাকা দিতেন না। টাকা চাইলে শুনতে হতো হুমকি। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এমন নানান অভিযোগ উঠেছে পটুয়াখালীর মহিপুর থানার (ঝালকাঠি সদর ফাঁড়ি ইনচার্জ) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খোন্দকার মো. আবুল খায়েরের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

Advertisement

পটুয়াখালীর পশ্চিম কুয়াকাটা এলাকায় সড়ক লাগোয়া ৭ শতাংশ জমিতে করা বাড়িতে পরিবার নিয়ে গত ৩০ বছর ধরে বসবাস করে আসছেন স্থানীয় হালিম মোল্লা। ২০২৩ সালের ২ এপ্রিল রাতে হালিম মোল্লাকে একটি মামলায় সাক্ষ্য দিতে তার ছেলেসহ থানায় নিয়ে আসেন তৎকালীন মহিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খোন্দকার মো. আবুল খায়ের। পরের দিন সকালে তাদের একটি মামলায় আসামি দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। সাতদিন হাজতবাস শেষে বাড়ি ফিরে দেখেন, কোনো অর্থ পরিশোধ না করে তার বাড়িসহ পাশে কেনা ৬০ শতাংশসহ মোট ৬৭ শতাংশ জমির চারপাশে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা। বাড়িতে প্রবেশ করতে চাইলে মামলা ও গুম হওয়ার হুমকিও পান তিনি। একমাত্র বাসস্থানটি হারিয়ে অসহায় পরিবারটি আজ ভূমিহীন। জমি দখলে নিয়ে সেখানে ওই জমির মালিক হিসেবে ওসি খায়েরের শ্বশুর এনায়েত করিমের নামে সাইনবোর্ড সাঁটিয়ে দেওয়া হয়।

সরেজমিন দেখা যায়, সাইনবোর্ডে জমির তফসিল উল্লেখ থাকলেও পরিমাণ উল্লেখ নেই। রেজিস্ট্রি বায়নাসূত্রে জমির মালিক এনায়েত করিম।

ভুক্তভোগী হালিম মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে কখনো কারও মন কালাকালিও হয়নি। হঠাৎ ওইদিন রাতে আমাদের পুলিশ পাঠিয়ে থানায় নেয়। প্রথমে বলে একটা সাক্ষ্য দিতে হবে। পরে আমাদের আসামি করে জেলে পাঠায়।’

Advertisement

তিনি বলেন, ‘আমি যে ঘরে থাকতাম সেই ঘরটি এখনো পড়ে আছে। ওসি যে জমি কেড়ে নিয়েছে তার বর্তমান বাজারমূল্য ৪-৫ কোটি টাকা। আমরা এতদিন কথা বলতে পারেনি পুলিশ আসতো কয়দিন পরপর। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা মেরে ফেলারি হুমকি দিতো ওসির পক্ষ হয়ে। আমার আর কোনো দাবি নাই, আমি আমার জমিটুকু ফেরত চাই। প্রয়োজনে আমি এখন তার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেবো।’

শুধু জমি দখল নয়, মহিপুর থানায় কর্মরত অবস্থায় আবাসিক হোটেল, খাবার হোটেল, মৎস্য বন্দর, ফিশ ফ্রাই, বাইক, ট্যুরিস্ট বোট, নির্মাণাধীন ভবন থেকে চাঁদা দিতে হতো ওসি আবুল খায়েরকে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মহিবুর রহমানের কাছের লোক হওয়ায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের প্রতিনিয়ত হয়রানি ও ক্ষমতা দেখিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতেন বলে অভিযোগ রয়েছে এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

ওসি আবুল খায়েরের হয়রানির শিকার হয়েছেন কনটেন্ট ক্রিয়েটর সাদ্দাম মাল। তিনি বলেন, ‘এই ওসি চাইতো আমি সবসময় তাকে নিয়ে ফেসবুকে প্রশংসা করে তার ছবি দিয়ে পোস্ট করি। আমি তার কথা না শোনার কারণে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাকে থানায় নিয়ে যায়। পরে একটি মামলার আসামি করে হাজতে পাঠায়। শুধু আমার সঙ্গে নয়, বেশিরভাগ মানুষের সঙ্গে সে এই কাজটা করতো। আমরা তার সঠিক বিচার চাই।’

হোটেল রেইনবো ইনের মালিক সোহেল রানা। তিনি বলেন, ‘ওইসময়ে কে বা কারা আওয়ামী লীগের একটি অফিস ভাঙচুর করে। এর একদিন পর আমার হোটেলের সামনে এসে আমাকে ডেকে নেন। একজন কনস্টেবলের মাধ্যমে জানান, ৩০ হাজার টাকা লাগবে, না হয় মামলার আসামি করবে। পরে আমি নিজের এবং হোটেলের নিরাপত্তার জন্য ছয হাজার টাকা দেই। এরপরে বাকি টাকা দেওয়ার জন্য বারবার ফোন করে চাপ দেন। পরে আমি এলাকা ছেড়ে চলে যাই। তিনি এখান থেকে চলে যাওযার পর আমি বাড়িতে আসি।’

Advertisement

ওসি আবুল খায়েরের হুমকি পেয়েছেন আন্ধারমানিক ট্যুরিজমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেএম বাচ্চু। তিনি বলেন, ‘আমার বোটে করে এসপিসহ অফিসারদের ভ্রমণ করানো ১৫ হাজার টাকা পাই। সেই টাকা এসপি স্যার ওসি খায়েরের কাছে দিয়েছেন। কিন্তু ওসি সেই টাকা আমাকে দেননি। গত ১৫ আগস্ট এটা নিয়ে আমি ফেসবুকে লেখালেখি করলে তিনি ফোন করে আমাকে টাকাটা বিকাশের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। পরে আমি কেন লেখালেখি করলাম সেজন্য এখনো হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন।’

হোটেল বৈশাখী অ্যান্ড বিরিয়ানি হাউজের মালিক ইমাম হোসেন বলেন, ‘আমার কাছ থেকে তিনি বিভিন্ন সময় মেহমান নিয়ে আসতেন। তবে খেয়ে ঠিকমতো বিল দিতেন না। আমি এখনো ২৭ হাজার ৮০০ টাকা পাবো। তিনি টাকা দিচ্ছেন না। টাকা চাইলে হুমকি দেন।’

আরেক ভুক্তভোগী আলীপুর সানপাওয়ার ভ্যারাইটিজ স্টোরের মালিক আল সাঈদ। তিনি বলেন, ‘ওসি আবুল খায়ের এখানে আসার পর আমার কাছ থেকে তার বাসার ক্রোকারিজের জিনিসপত্র নিতেন এবং তার অফিসারদের বিভিন্ন সময়ে উপঢৌকন পাঠাতেন। আমি তার কাছে ৪২ হাজার ৯৬২ টাকা পাবো। যখন টাকা চাইতাম তখন বলতেন, বিএনপি করো। টাকা চাইলে মামলার আসামি হবা তুমি, তোমার বাবা। আমরা সবসময় তার ভয়ে আতঙ্কে থাকতাম।’

কাওসার ফিশ ফ্রাইয়ের মালিক কাওসার মুসল্লি বলেন, ‘আমার দোকানে এসে বলেন, মার্কেট থেকে এক লাখ টাকা দিতে হবে। আমরা টাকা জোগাড় করতে না পারায় বিদ্যুতের লাইন কেটে দেন। পরে আমি ওসি খায়েরকে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে আসি। এরপরে লাইন সচল করেন। বিভিন্নভাবে আমাদের হয়রানি করতেন তিনি।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথমে তদন্ত অফিসার হয়ে কলাপাড়ার মহিপুর থানায় আসেন আবুল খায়ের। পরে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন এমপি মহিবুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় থানার ইনচার্জের দায়িত্ব পান। পরে প্রশাসনিক কাজে অসহযোগিতাসহ নানা অভিযোগে তাকে পটুয়াখালী পুলিশ লাইনস থেকে ঝালকাঠি জেলার সদর থানার শেখেরহাট তদন্ত কেন্দ্রে পাঠানো হয়। বর্তমানে ঝালকাঠি সদর ফাঁড়ি ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত আবুল খায়ের।

কুয়াকাটা পৌর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম মিরন বলেন, ‘সাবেক প্রতিমন্ত্রী মহিবুর রহমানের কাজ বাস্তবায়নই ছিল ওসি খায়েরের প্রধান কাজ। প্রায় রাতেই তিনি বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িতে গিয়ে হয়রানি করতেন। চাহিদামতো টাকা না দিলে তুলে নিয়ে মামলার আসামি করতেন।’

এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত ওসি আবুল খায়েরের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে পটুয়াখালী জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) আহমাদ মাঈনুল হাসান বলেন, সাবেক এই ওসির বিরুদ্ধে জেলা পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসআর/এএসএম