• বছরের ৬ মাসই প্লাবিত থাকে গো-চারণভূমি• হাওরের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আনতে হয় ঘাস • ৬০০ পরিবারের জন্য বরাদ্দ দুই প্যাকেট গো-খাদ্য
Advertisement
ঘড়ির কাঁটায় তখন ভোর ৪টা। বৈঠা হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন ৪০ বছর বয়সী কৃষক রুবেল আহমদ। টর্চলাইটের আলোয় নৌকা নিয়ে যাত্রা শুরু করেন হাওরের দিকে। বিশাল হাওরের মাঝখানে যখন পৌঁছে যান, তখন চারদিকে নিস্তব্ধতা। ভোরের আলো ফোটার আগেই নৌকা নিয়ে হাওরের অপর প্রান্তে পৌঁছে যান রুবেল।
মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে হাওরের বড় বড় ঢেউ মাড়িয়ে রুবেলের এই ছুটে চলা নিজের জীবনের জন্য নয়। গবাদিপশুর খাদ্য জোগাতে প্রতিদিনই এই যুদ্ধ করতে হয় রুবেলকে। প্রতিদিনই নৌকায় হাওরের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গবাদিপশুর জন্য ঘাস আনতে যান তিনি।
রুবেলের বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বারহাল ইউনিয়নের বাটইশাইল গ্রামে। এই গ্রামের প্রতিটি পরিবারেই একজন করে ‘রুবেল’ রয়েছেন, যারা প্রতিদিনই এরকম যুদ্ধ করে গবাদি পশুর খাবার জোগাড় করেন। বর্ষা মৌসুমে অন্তত ছয় মাস এভাবে গরু-মহিষ বাঁচাতে হাওর থেকে ঘাস সংগ্রহ করেন এই গ্রামের কৃষকরা।
Advertisement
চলতি বছরের ২৭ মে ভারী বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে সিলেটে প্রথম দফায় বন্যা দেখা দেয়। সেইসময় বন্যা আক্রান্ত হয় বাটইশাইল গ্রাম। এরপর তিন দফায় সিলেটে বন্যা দেখা দেয়। বন্যায় প্লাবিত হয় সিলেটের দেড় শতাধিক গ্রাম। সব এলাকা থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও হাওরবেষ্টিত বাটইশাইল গ্রামের চারপাশ এখনো পানিতে থই থই করছে।
চলতি সপ্তাহ থেকে সিলেটে ফের বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। নদ-নদীর পানিও বাড়তে শুরু করেছে এরইমধ্যে। এতে বাটইশাইল গ্রামের কৃষকদের দুর্ভোগ আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জের বাটইশাইল গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামটির তিন পাশে ছোট-বড় অনেকগুলো হাওর রয়েছে। এরমধ্যে পূর্বদিকে উপজেলার সবচেয়ে বড় মইলাইট হাওর, উত্তরে বালাই ও ডুবাইল হাওর, দক্ষিণে কালিওর হাওর এবং উত্তর-পূর্ব দিকে ছেফটির হাওর।
হাওরবেষ্টিত এই গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। গ্রামটিতে অন্তত ৫০০-৬০০টি পরিবার রয়েছে। গ্রামটির সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। বর্ষা মৌসুমে নৌকা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
Advertisement
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষিপ্রধান এই গ্রামের প্রতিটি পরিবারের ৮-১০টি গরু রয়েছে। চারটি পরিবারে অন্তত ২০-২৫টি মহিষও রয়েছে। হাঁসের পালও রয়েছে অসংখ্য পরিবারে। সবমিলিয়ে গবাদিপশুতে সমৃদ্ধ বাটইশাইল গ্রাম।
গ্রামের কৃষক রুবেল আহমদ বলেন, ‘গত মে মাসে হাওরে প্রথমে বৃষ্টির পানি ঢোকে। পরে কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যায় পুরো গ্রাম। বেশ কিছুদিন পর গ্রামীণ সড়ক থেকে পানি নেমে গেলেও বিস্তীর্ণ এলাকা ও গ্রামের চারপাশ পানিতে প্লাবিত রয়েছে। বৃষ্টিপাত বাড়লে পানি বাড়ে। আবার বৃষ্টিপাত কমলে পানি কিছুটা কমে। তবে মে মাসের পর থেকে এখনো গ্রামের চারপাশ শুকায়নি। গো-চারণভূমি পানিতে তলিয়ে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিবছরই এরকম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। একবার বন্যার পানি ঢুকলে বছরের অন্তত ছয় মাস পানি নামে না। যে কারণে বন্যা এলে চরম সংকটে পড়েন গ্রামের কৃষকরা। বিশেষ করে গবাদিপশু বাঁচাতে হিমশিম খেতে হয় সবাইকে।’
‘প্রায় চার মাস ধরে বিস্তীর্ণ এলাকার কোথাও এক টুকরো শুকনা জায়গা নেই। কোথাও ঘাসের দেখা নেই। শুকনো খড়ের জোগানও নেই। প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই গ্রামের প্রত্যেক পরিবারের একজন কৃষক ছুটে যান হাওরে। হাওরের পানি থেকে ঘাস কেটে এনে গরু-মহিষকে খেতে দেওয়া হয়। মাঝে মধ্যে কলাগাছের পাতাও খাওয়ানো হয়। খাবার ইচ্ছা না থাকলেও ক্ষুধার্ত পশুরা এসব খেয়েই কোনোরকমে বেঁচে আছে’, যোগ করেন কৃষক রুবেল।
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন হাওর থেকে ঘাস আনতেও গ্রামের মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। হাওরে যে আগে যেতে পারে, সে নৌকা ভর্তি করে ভালো ঘাস নিয়ে আসে। এজন্য প্রতিদিন ফজরের আগেই যেতে হয় হাওরে।’
এ বিষয়ে সরকারি কোনো সহযোগিতা না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন গ্রামের আরেক কৃষক রায়হান আহমদ ওরফে খলু মিয়া। তিনি বলেন, ‘এবছর তিন দফায় বন্যার পানিতে গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে রয়েছেন কৃষকরা। গ্রামের অন্তত ৫-৬ হাজার গরু-মহিষ গৃহবন্দি রয়েছে। গো-খাদ্যের চরম সংকট প্রতিটি ঘরে। কিন্তু সরকারি কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘শুনেছি এবারের বন্যায় সরকারের পক্ষ থেকে অনেক গো-খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের গ্রামে বরাদ্দ এসেছে কি না জানা নেই। আমরা গবাদিপশুকে বাঁচাতে প্রতিদিনই যুদ্ধ করে যাচ্ছি।’
স্থানীয় ইউপি মেম্বার ইমান উদ্দিন বলেন, আমার ওয়ার্ডের দুটি গ্রামে অন্তত ১২০০ পরিবার রয়েছে। প্রায় প্রতিটি পরিবারের গরু-মহিষ রয়েছে। তিন দফা বন্যায় এখন পর্যন্ত গো-চারণভূমি পানিতে তলিয়ে থাকায় গরু-মহিষ গৃহবন্দি রয়েছে। গো-খাদ্যের চরম সংকট ঘরে ঘরে। কিন্তু এত বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য মাত্র দুই প্যাকেট গো-খাদ্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এই দুই প্যাকেট মাত্র দুই কৃষককে দেওয়া হয়েছে। বাকিরা বঞ্চিত রয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘গো-খাদ্যের সংকটে গবাদিপশু মারা যাচ্ছে। অনেকে পশু পালনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে গবাদিপশু সমৃদ্ধ এই গ্রাম থেকে গরু-মহিষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’
গো-খাদ্য সংকটের কথা বলেন বারহাল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরীও। তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নের প্রথম দফায় ২৭ প্যাকেট ও দ্বিতীয় দফায় ১০ প্যাকেট গো-খাদ্য বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে সমানভাবে বিতরণ করা হয়েছে। গো-খাদ্যের অনেক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সরকার থেকে না এলে আমারও দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
তিনি বলেন, আমি অনেকবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছে। কিন্তু আলাদা করে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফসানা তাসলিম বলেন, ‘বন্যায় উপজেলায় গো-খাদ্যের জন্য এক লাখ ৬০ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের মাধ্যমে ‘রেডি ফিড’ বিতরণ করা হয়েছে। গো-খাদ্যের জন্য নতুন করে বরাদ্দ চাইতে পারি। কিন্তু দে কি না বুঝতে পারছি না।’
এসআর/এএসএম