প্রবাস

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত: পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা ও নতুন দৃষ্টিকোণ

প্রত্যেক দেশের জাতীয় সংগীত তার পরিচয়, ইতিহাস এবং জাতির গভীর আবেগের প্রতীক। জাতীয় সংগীত কেবল একটি গান নয়, এটি একটি দেশের নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য, তাদের গৌরবময় অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য এবং ভবিষ্যতের পথে চলার প্রেরণা দেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Advertisement

তবে, বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ এক্ষেত্রে কতটা প্রাসঙ্গিক, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। যদিও এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিনিধিত্ব করে, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের পুরো সত্যকে প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয়নি।

আমার সোনার বাংলা এবং তার সীমাবদ্ধতা:

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত একটি অনন্য সৃষ্টি, যা আমাদের মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করে। তবে, এই গানটি যখন বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তখন এর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনও যুক্ত হয়ে থাকে। ‘বাংলা’ বলতে শুধু বাংলাদেশকেই বোঝায় না; এর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গও জড়িত। এ কারণে, এটি আমাদের জাতীয় পরিচয়ের পুরোপুরি প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।

গত ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের এই দ্বৈত পরিচয়ের বিষয়টি জাতিগত, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। যখন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের কথা আসে, তখন এটি একটি স্বাধীন জাতির আত্মপরিচয় এবং আত্মমর্যাদার প্রতীক হতে হবে। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানে যেমন আমাদের মাটির প্রতি গভীর ভালোবাসা রয়েছে, তেমনি এটি আমাদের আত্মত্যাগ, সংগ্রাম ও স্বাধীনতার জন্য যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে, তার সঠিক প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম নয়।

Advertisement

নতুন দৃষ্টিকোণ: সালাম সালাম হাজার সালাম:

‘সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে’ গানটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত, বাংলাদেশ একাধিক চ্যালেঞ্জ ও ঝড়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। এই গানটি সেই সমস্ত সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগের একটি প্রামাণিক দলিল, যা আমাদের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দেওয়া লাখো শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।

এই গানটি জাতির প্রতিটি কোণে প্রেরণা জোগায় এবং আমাদের ইতিহাসের গভীরতা ও তাৎপর্যকে তুলে ধরে। যখন আমরা ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি শুনি, তখন আমাদের মনে শহীদদের আত্মত্যাগ, তাদের বীরত্ব এবং দেশের জন্য ভালোবাসার স্মৃতি জাগ্রত হয়। এটি আমাদের জাতীয় চেতনায় একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি যোগায়, যা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির পক্ষে সম্ভব নয়।

অন্যান্য দেশের জাতীয় সংগীতের তাৎপর্য এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট:

বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংগীত তাদের সংগ্রামের ইতিহাস, সাহসিকতা এবং জাতীয় চেতনার প্রতীক হিসেবে পরিচিত। উদাহরণস্বরূপ:

ফ্রান্সের ‘লা মার্সেইয়েজ’ গানটি ফরাসি বিপ্লবের সময় রচিত হয় এবং ফরাসি জনগণের মুক্তির জন্য তাদের সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগকে তুলে ধরে। এটি আজও ফ্রান্সের জাতিগত ঐক্য এবং স্বাধীনতার প্রতীক।

Advertisement

আমেরিকার ‘দ্য স্টার স্প্যাঙ্গলড ব্যানার’ তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতীক হিসেবে গাওয়া হয়, যা তাদের জাতির সংহতি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিফলন।

জার্মানির জাতীয় সংগীত ‘ডাস ডয়েচল্যান্ডলিড’ (Deutschlandlied) এর তৃতীয় স্তবকটি জাতীয় সংগীত হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা স্বাধীনতা, ঐক্য এবং ন্যায়ের প্রতি জার্মান জাতির প্রতিশ্রুতি ও বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে। এটি দেশপ্রেম, ঐক্য এবং ন্যায়বিচারের মূল চেতনাকে উদযাপন করে।

সুইডেনের জাতীয় সংগীত ‘ডু গামলা, ডু ফ্রিয়া’ (Du gamla, Du fria), যার অর্থ ‘তুমি প্রাচীন, তুমি মুক্ত’, সুইডেনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, স্বাধীনতা এবং গৌরবময় ঐতিহ্যের প্রতীক। এটি সুইডিশ জনগণের দেশপ্রেম এবং প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসাকে উদযাপন করে, যদিও এটি আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি।

জাপানের জাতীয় সংগীত ‘কিমিগায়ো’ (君が代), যার অর্থ ‘তোমার শাসনকাল’, সম্রাটের দীর্ঘায়ু এবং দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির কামনা করে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন এবং সবচেয়ে ছোট জাতীয় সংগীতগুলোর একটি, যা জাপানি ঐতিহ্য ও সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের প্রতীক।

স্পেনের জাতীয় সংগীত ‘লা মার্চা রেয়াল’ (La Marcha Real), যার অর্থ ‘রয়্যাল মার্চ’, এটি একটি গীতিকথাহীন বাদ্যযন্ত্র সংগীত। এটি স্পেনের রাজকীয়তা, ঐতিহ্য এবং জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয় এবং বিভিন্ন সরকারি ও আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে বাজানো হয়। স্পেনের জাতীয় সংগীতে কোনো লিরিক নেই, যা এটিকে অন্য দেশের জাতীয় সংগীতের তুলনায় আলাদা করে তোলে, তবে এটি স্পেনের জনগণের মধ্যে গভীর দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, জাতীয় সংগীতের সেই ঐতিহাসিক তাৎপর্য থাকার প্রয়োজন, যা আমাদের জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের সঠিক পরিচায়ক হবে। ‘আমার সোনার বাংলা’ একটি সুন্দর গান হলেও, এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে এবং ভৌগোলিক সীমায় আটকে আছে; এটি আমাদের আত্মত্যাগ এবং সংগ্রামের প্রতিফলন ঘটাতে পুরোপুরি সক্ষম নয়।

‘সালাম সালাম হাজার সালাম’: সত্য এবং বাস্তব দলিল:

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ—এই সমস্ত ঘটনাগুলো একটি অভিন্ন ইতিহাসের অংশ। ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি এই সমস্ত আত্মত্যাগ এবং সংগ্রামের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে।

এই গানটি আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত এবং এটি একটি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হতে পারে। এটি আমাদের জাতির প্রকৃত পরিচয়, আত্মত্যাগ এবং সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি হিসেবে দাঁড়াবে। ১৯৫২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে যে সমস্ত ঝড় বয়ে গেছে, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি সেই সব সংগ্রামের যথার্থ প্রতিফলন এবং স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

প্রস্তাবের প্রয়োজনীয়তা:

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সংগীতটি দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসার কথা বলে; কিন্তু যদি এই ভালোবাসা দেশের বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যেত, তবে আমরা গত ৫৩ বছর ধরে দেখতাম না যে দেশের অবস্থা শুধুমাত্র দুর্নীতি, অন্যায়, হত্যা, নিপীড়ন, প্রতিহিংসা, বৈষম্য, আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং অর্থ পাচারের মতো ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। এই কর্মকাণ্ডগুলো কোনোভাবেই ‘সোনার বাংলা’কে ভালোবাসার দলিল হতে পারে না। এটি আমাদের সবার জন্য গভীরভাবে ভাবার বিষয়।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা:

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাব কেবল একটি গানের পরিবর্তন নয়; এটি আমাদের জাতীয় পরিচয়, ইতিহাস এবং স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থকে পুনঃস্থাপনের প্রয়াস। ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি আমাদের জাতির ইতিহাসের সত্য ও বাস্তব দলিল হিসেবে কাজ করবে এবং নতুন প্রজন্মকে তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মত্যাগের জন্য গর্বিত করবে। এটি আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আবেগপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে, যা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে নতুন করে ঐক্য, গৌরব এবং চেতনার জন্ম দেবে।

এখন সময় এসেছে, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের বিষয়ে নতুন করে ভাবনার এবং জাতীয় আলোচনা শুরু করার, যেন আমরা আমাদের ইতিহাসের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে পারি এবং একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে নিজেদের উপস্থাপন করতে পারি।

রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com

এমআরএম/জেআইএম