খেলাধুলা

এবারই প্রথম নয়, টেস্টে ‘নতুন বাংলাদেশের’ দেখা মিলেছিল আগেই

অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন দিনের সূচনা হলো। আবার কারও কারও মত, বাংলাদেশের টেস্ট আকাশে নতুন সূর্যের উদয় হলো।

Advertisement

আসলে কি তাই? রাওয়ালপিন্ডিতে সত্যিই নতুন যাত্রা শুরু করলো বাংলাদেশ? এটা সত্যি, পারফরমেন্স ও ফলকে মানদণ্ড ধরলে টেস্টে এটাই বাংলাদেশের সেরা পারফরম্যান্স। তবে এটাই টেস্টে নতুন পথে যাত্রার উদাহরণ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়।

ইতিহাস জানাচ্ছে, জিম্বাবুয়ের ছাড়া বড় দলের তকমাধারীদের মধ্যে এর আগে শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই ২-০’তে টেস্ট সিরিজ বিজয়ের রেকর্ড ছিল বাংলাদেশের। সেটা ২০০৯ সালে।

কিন্তু ওই সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দলটি ছিল দুর্বল। কমজোরি। অনভিজ্ঞ। যেখানে সে সময়ের একজন তারকা ও প্রতিষ্ঠিত পারফরমারও ছিলেন না। তারপর কেটে গেছে ১৫ বছর।

Advertisement

এ দীর্ঘ সময়ে কোনো প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটশক্তিকে আর দেশে কিংবা বিদেশে কোথাও হোয়াইটওয়াশ করা সম্ভব হয়নি। এবার পাকিস্তানকে ২ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে নাকাল করে ছাড়লো বাংলাদেশ। শুধু পরিসংখ্যানের আলোকেই নয়, এবার পাকিস্তানের বিপক্ষে টাইগারদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, অ্যাপ্রোচ, অ্যাপ্লিকেশন আর পারফরম্যান্সও ছিল নজরকাড়া। অসাধারণ।

পুরো সিরিজে ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলার প্রাণপণ চেষ্টা ছিল টাইগারদের। প্রতিটি সেশনে নিজেদের করণীয় কাজগুলো সঠিকভাবে করার ক্ষেত্রেও এবার টাইগাররা আগের যে কোনো সিরিজের তুলনায় দেখিয়েছেন দক্ষতার ছাপ।

তবে ইতিহাস, পরিসংখ্যান জানাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরেই টেস্টে ভালো খেলতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। অ্যাপ্রোচ, পারফরম্যান্সে উন্নতির ছোঁয়া লেগেছিল আগেই।

২০১৫ সালে খুলনায় পাকিস্তানের বিপক্ষে ২৯৬ রানে পিছিয়ে পড়ে দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েসের প্রথম উইকেটে তোলা রেকর্ড ৩১২ রানের জুটিতে নিশ্চিত হার এড়িয়ে ড্র করার পর থেকেই আসলে টেস্টে নতুন পথের সন্ধান পায় বাংলাদেশ।

Advertisement

এরপরের বছর, তথা ২০১৬ সালের অক্টোবরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয় দিয়ে শুরু। মেহেদি হাসান মিরাজের অনন্য অসাধারণ বোলিংয়ে (৬/৮২ ও ৬/৭৭, মোট ১৫৯ রানে ১২ উইকেট) ১০৮ রানের দারুণ জয় পায় বাংলাদেশ। সেটা ছিল ২ ম্যাচ সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট। ওই জয়ে টাইগাররা সিরিজ অমীমাংসিতভাবে শেষ করে।

কিন্তু চট্টগ্রামে প্রথম টেস্টে অফস্পিনার মিরাজ তার নিজের টেস্ট অভিষেকে প্রথম ইনিংসে ৮০ রানে ৬ উইকেট পেলেও ম্যাচে বাংলাদেশ হেরে যায় ২০ রানে। পরের বছর মানে ২০১৭ সালে টাইগাররা পায় দুটি বড় জয়। প্রথমটি মার্চে কলম্বোর পি সারা ওভালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নিজেদের শততম টেস্টে ৪ উইকেটের জয়। আর পরেরটি সে বছর আগস্টে আবার ঘরের মাঠে শেরে বাংলায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০ রানের জয়।

এরপর ধীরে ধীরে সাফল্যর সূর্যটা মেঘে ঢাকা পড়ে যেতে থাকে। ২০১৮ সালে ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ২ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ ২-০’তে জয়টা ছিল বড় ঘটনা। এছাড়া জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজও জেতা সম্ভব হয়নি। ১-১’এ অমীমাংসিত থাকে।

২০১৯ সালে সবচেয়ে করুণ অবস্থা ছিল টাইগারদের। ৫ টেস্টেও সবকটাতেই হার। ২০২০ ও ২০২১ সালে জিম্বাবুয়ে ছাড়া আর কোনো বড় দলকে হারানো সম্ভব হয়নি। অবশেষে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দেখা দেয় দারুণ এক জয়ের।

অধিনায়ক মুমিনুল হক (৮৮), লিটন দাস (৮৬), মাহমুদুল হাসান জয় (৭৪) আর নাজমুল হোসেন শান্তর (৬৪) দুর্দান্ত ব্যাটিং ও পেসার এবাদত (৬/৪৬, তাসকিন (৩/৩৬), শরিফুল (৩/৬৯ ) এবং অফস্পিনার মিরাজের (৩/৮৬) বোলিং তোড়ে খাবি খায় কিউরা। যে দেশে গিয়ে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিষ্ঠিত শক্তিও দাঁড়াতে পারে না, সেই নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টাইগারদের অমন নজরকাড়া টিম পারফরম্যান্স এবং পেসারদের ম্যাচ জেতানো বোলিং সবার অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়ায়।

অনেকেই বলে বসেন, টেস্টে বাংলাদেশের খারাপ দিন কেটে গেছে। এখন নতুন পথের সন্ধান পেয়েছে বাংলাদেশ। সে পথে হেঁটে ওই বছর ডিসেম্বরে ভারতের সঙ্গে মিরপুরে সমানতালে লড়াই করে প্রায় জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিল টাইগাররা। শেষ পর্যন্ত তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ সে টেস্টে ভারত জিতে যায় ৩ উইকেটে।

পরের বছরও (২০২৩) সে ভালো খেলার মাত্রাটা সচল ছিল টাইগারদের। সেবার ৪ টেস্ট খেলে তিনটিতে জয়ী হয় বাংলাদেশ। অবশ্য সবকটা দেশের মাটিতে। সিলেটে নিউজিল্যান্ডকে (১৫০), মিরপুরে আফগানিস্তানকে ৫৪৬ রানে এবং শেরে বাংলায় আয়ারল্যান্ডকে ৭ উইকেটে হারিয়ে দেয় টাইগাররা।

তারপর আবার সাফল্যের সূর্যটা মেঘে ঢাকা পড়ে গেছে। পাকিস্তান যাওয়ার আগে এ বছর মার্চে ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে চরমভাবে নাকাল হয় শান্তর দল। ১৯২ আর ৩২৮ রানের দু-দুটি বড় পরাজয় থাকে সঙ্গী। তারপর ৪ মাস টেস্ট থেকে দূরে ছিল টিম বাংলাদেশ। এবার পাকিস্তান গিয়ে আবার নিজেদের খুঁজে পেলো তারা।

টিম স্পিরিট, টিম ইফোর্ট আর টিম পারফরম্যান্সের অনুপম মিশেলে পাকিস্তানকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে ‘বাংলাওয়াশ’ করে আবার ক্রিকেট বিশ্বে আলোড়ন তুললো টাইগাররা।

ওপরের তথ্য ইতিহাস ও পরিসংখ্যান পরিষ্কার বলে দিচ্ছে, শুধু এই সিরিজেই নয়, বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরেই টেস্টে ধীরে ধীরে উন্নতি করেছে। ব্যাটারদের পাশাপাশি পেসাররা উঠে এসে প্রতিপক্ষ ব্যাটিং লাইন আপে ঝাঁকুনি দেওয়ার কাজটা ভালোই রপ্ত করেছেন পেসাররা।

বরাবর জানা ছিল, মানাও হতো টেস্টে বাংলাদেশের প্রধান অস্ত্র হলেন স্পিনাররা; কিন্তু ২ বছর আগে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। পেসার এবাদতের বিধ্বংসী স্পেলে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় কিউই ব্যাটিং।

বাংলাদেশ পায় ৮ উইকেটের ঐতিহাসিক জয়। এবার তার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন হাসান মাহমুদ ও নাহিদ রানারা। মুশফিক, লিটন দাস, মিরাজ, সাদমান ও মুমিনুলদের ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বল হাতে জ্বলে উঠে দল জেতানো বোলিং করেছেন পেসারারাও।

আর মাত্র ১৩ দিন পর ভারতের বিপক্ষে ২ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ। দেখা যাক পাকিস্তানকে ‘বাংলাওয়াশ’ করার অনুপ্রেরণায় ভারতের সঙ্গে কী করে বাংলাদেশ?

এরআরবি/আইএইচএস