জাতীয়

সর্বনাশের শুরু যেখান থেকে

১৮ আগস্ট। ঘড়ির কাঁটায় রাত তখন আনুমানিক ২টা। মাত্র দু’ঘণ্টা আগেই টহল দিয়ে ক্যাম্পে ফিরেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। ফেনীর পরশুরাম উপজেলার নিজকালিকাপুর গ্রামের চারদিকে থৈ থৈ করছে পানি। মুহুরী নদীতেও পানি বাড়ছে ক্রমাগত। পুরো অন্ধকার এলাকাটির মানুষের চোখে ঘুম নেই। সবার চোখ পানির দিকে। সীমান্ত এলাকাজুড়ে বাড়ছিল আতঙ্ক। কখন কোনদিকে ভেঙে যায় মুহুরীর বাঁধ, প্লাবিত হয় জনপদ, এ নিয়েই তটস্থ ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা!

Advertisement

এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, এরই মধ্যে বার কয়েক ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) আনাগোনা সন্দেহজনক মনে হয় এলাকাবাসীর। কারণ, এর আগে একবার বাঁধ কেটে এ অঞ্চলটি পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছিল তারা। স্থানীয়রা জানান, এবারও শেষ রক্ষা হলো না, বরং মানুষের সন্দেহই সত্যি হলো। ওই রাতে নিজকালিকাপুর এলাকার ২০৫৯ থ্রিএস সীমানা পিলারের পাশের বাঁধটি কেটে দেয় বিএসএফ। টের পেয়ে বাংলাদেশ অংশ থেকে হাঁকডাক দিলে পাঁচ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়। তবে এরই মধ্যে ভয়ঙ্কর ও সর্বনাশা রূপ নিয়ে দ্রুত পানি ঢুকতে থাকে জনপদে।

পানির প্রচণ্ড চাপ বাঁধের ধারের গাছ, এমনকি বাঁশঝাড়গুলোও লোকালয় ও আশপাশের মাঠে ভাসিয়ে নেয়। মুহূর্তেই পুরো এলাকায় পানি বেড়ে হয়ে যায় বুক সমান। বানের পানির সেই সর্বগ্রাসী স্রোত দুঃস্বপ্নের মতো ভাসিয়ে নেয় মানুষ, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, চাষের মাছ এবং মাঠের পর মাঠের ফসল। রাত্রির অন্ধকারের মতোই চরম দুর্দশা নামে জনপদজুড়ে।

মুহূর্তেই পুরো এলাকায় পানি বেড়ে হয়ে যায় বুক সমান। বানের পানির সেই সর্বগ্রাসী স্রোত দুঃস্বপ্নের মতো ভাসিয়ে নেয় মানুষ, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, চাষের মাছ এবং মাঠের পর মাঠের ফসল। রাত্রির অন্ধকারের মতোই চরম দুর্দশা নামে জনপদজুড়ে

Advertisement

আরও পড়ুন ফেনীতে এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে ২০ হাজার মানুষ বন্যায় মৃত্যু বেড়ে ৬৭: ত্রাণ মন্ত্রণালয় বন্যায় ১২০৬ স্কুল-কলেজের ক্ষতি, ৫৬৫টিতে ক্লাস বন্ধ

প্রবল পানির স্রোতে রাতারাতি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা, চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলা এবং চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা প্লাবিত হয়। সেসব এলাকার পানি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করেছে। তবে এখনো বহু মানুষ পানিবন্দি। চারদিকে বন্যার ক্ষতও এখনো দগদগে।

২ সেপ্টেম্বর (সোমবার) সরেজমিনে দেখা যায়, বাঁধের কেটে দেওয়া অংশটি ভেসে উঠেছে। এখন স্বাভাবিক গতিতে নদীতে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ওই অংশে নদীর পাড় কোয়ার্টার কিলোমিটার ছন্নছাড়া হয়েছে গেছে। বাঁধের পাশের গাছগুলো এক-দুই কিলোমিটার দূরে ফসলের মাঠে শেকড়সহ ভেসে উঠেছে। মাঠজুড়ে ফসলের ওপরে এখন প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু বালুর স্তর। বানের পানিতে এলাকার কারও ঘর ভেসে গেছে, কারও গবাদি পশু বা মাছের খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারও আবার একরের পর একর জমির ফসল শেষ। সেসব জমি এখন শুধুই ধু ধু বালুচর। সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েও দুর্গত মানুষেরা যে যার মতো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ক্ষতি পোষাতে সবার সহযোগিতা চান। প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা, ফসলের মাঠ সংস্কার ও কৃষি বীজ, খামারের পুঁজি, শিক্ষায় প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং সুচিকিৎসা এখন জরুরি প্রয়োজন।

বেড়িবাঁধের সংস্কার চায় এলাকাবাসী

সীমান্তবর্তী মানুষের সব দাবির প্রধান দাবি, বাঁধ সংস্কার। কারণ যে কোনো মুহূর্তে বৃষ্টি হলেই নদীর পানি লোকালয়ে ঢুকে যাবে। এতে তাদের আবারও ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।

Advertisement

মুহুরী নদীর নিজকালিকাপুর অংশের বাঁধ কেটে দেওয়া নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা আলী আকবর (৬৫) জাগো নিউজকে বলেন, ১৮ তারিখ সন্ধ্যায় তারা (বিএসএফ) বাঁধ কাটতে এসেছিল। আমরা পোলাপান নিয়ে পাহারা দিছি, কাটতে পারে নাই। রাত ১২টার দিকে বিজিবি টহলও দিয়ে গেছে। কিন্তু রাত ২টার দিকে বিএসএফ ৫-৬ রাউন্ড গুলি করে বাঁধ কাটি দিয়ে আউট হয়ে গেছে। তখন যেভাবে পানি ঢুকছিল, করার কিছু ছিল না। পোলাপান নিয়ে জীবন বাঁচিয়ে কোনো রকম স্কুলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছি। ঘরের মালামাল ও ঘরবাড়ি সব শেষ।

এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান কী? জানতে চাইলে এলাকার এই প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, ১৯৮৩ সালে যা করছে, তা-ই করতে হবে। ১৯৮৩ সালে বিলোনিয়া শহর (ত্রিপুরা রাজ্যের একটি শহর) বাঁচাতে ভারত এই বাঁধ কাটে। তখনো তারা কাটা বাঁধটি বাঁধেনি। পরে আমরা নিজকালিকাপুর থেকে রাঙ্গামাটিয়া টিলা পর্যন্ত বেড়িবাঁধ তৈরি করি। এতে পানি তাদের দিকেই যাওয়া শুরু করে, পরে তারা কাটা বাঁধটি সংস্কার করে।

১৯৮৩ সালে বিলোনিয়া শহর (ত্রিপুরা রাজ্যের একটি শহর) বাঁচাতে ভারত এই বাঁধ কাটে। তখনো তারা কাটা বাঁধটি বাঁধেনি। পরে আমরা নিজকালিকাপুর থেকে রাঙ্গামাটিয়া টিলা পর্যন্ত বেড়িবাঁধ তৈরি করি। এতে পানি তাদের দিকেই যাওয়া শুরু করে, পরে তারা কাটা বাঁধটি সংস্কার করে।- স্থানীয় বাসিন্দা আলী আকবর

‘এবারও ফেনীবাসীকে বাঁচতে হলে ১৯৮৩ সালের করা আমাদের নিজকালিকাপুর থেকে রাঙ্গামাটিয়া টিলা পর্যন্ত বেড়িবাঁধটি আবার সংস্কার করতে হবে। এটি করতে পারলে ভারত এমনিতেই তাদের বাঁধ সংস্কার করবে। অন্যথায় তারা নিজেরাই ডুবে মরবে’- যোগ করেন আলী আকবর।

স্থানীয় মো. বেলাল (৬০) বলেন, চার কানি জমি করছি, সব শেষ। সব এখন বালুর পাহাড়। তিনটা পুকুরের মাছ গেছে। বড় একটা ঘর ছিল, সেটাও গেছে। এগুলো তো গেছেই। সামনে যেন আর না যায়, সেজন্য এই বাঁধ বাঁধা জরুরি।

নিজকালিকাপুর গ্রামের আরেক বাসিন্দা ফিরোজ আহমদ (৭৮) বলেন, গত ২০-২৫ বছরেও ওয়াপদা কোনো কাজ করেনি। একমুঠো মাটিও আমাদের বাঁধে দেয়নি। অথচ ওদের (ভারতের) অংশে (বিলোনিয়া) ব্লক দেওয়া। আমাদের অংশে এরশাদের আমলে দেওয়া হয়েছিল, এখন আর নেই, নিচে পড়ে গেছে।

‘কিন্তু তারা (ভারত) একের পর এক ব্লক দিয়ে নিজেদের পাড় রক্ষা করে। এখন ভাঙার শঙ্কা দেখা দেওয়ায় সেগুলো আমাদের দিকে কেটে দিয়েছে। যে কারণে পরশুরাম, ফুলগাজী, ফেনী সদর, ছাগলনাইয়া, চৌদ্দগ্রাম এলাকায় বন্যার পানি উপচে পড়ে। এবার পানির চাপে ফেনীর দক্ষিণে লালপুলও ভেঙে গেছে। এরপর নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর এবং কুমিল্লার একটা অংশ হয়ে পানিটা নামতে শুরু করে।’

আমি নিজে এই (সেপ্টেম্বর) মাসেই মাঠপর্যায়ে গিয়ে প্রশাসন ও এলাকাবাসীর সঙ্গে গণশুনানি করবো। তারপর করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো। অবশ্যই জনদাবির প্রতি সম্মান দেখানো হবে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে তবেই চূড়ান্ত হবে সিদ্ধান্ত।- সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

ফিরোজ আহমদ বলেন, ২০৫৯ থ্রিএস থেকে ২১৪৮ পর্যন্ত সীমানা অমীমাংসিত। দিনে দিনে তারা আমাদের ভেতরে ঢুকছে। তাদের রাজ্য সরকার সীমানা নির্ধারণ করেছে, কিন্তু পিলার স্থাপনের অনুমতি দেয় না। এখন আবার বাঁধ কাটায় পিলারসহ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ৮৩’র বাঁধটি সংস্কার করেই এর সমুচিত জবাব দিতে হবে।

আরও পড়ুন বালুতে ঢেকে গেছে কৃষকের স্বপ্ন সেপ্টেম্বরে ফের বন্যার আভাস দিলো আবহাওয়া অধিদপ্তর বন্যার পানি নামায় কেন ধীরগতি?

একই এলাকার আব্দুল খালেক বলেন, যে ক্ষতি হয়েছে তা তো পোষাতে পারবো না। তবে ভবিষ্যতের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে মুহুরী নদীর বাঁধটি বাঁধতে হবে। যেহেতু ভারত তাদের অংশেই কেটে দিয়েছে, তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে এই বাঁধ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ সংক্রান্ত একটি পুরনো চুক্তিও তাদের সঙ্গে আমাদের আছে। যদি তারা সমঝোতায় না আসে, আমাদের বিকল্প বেড়িবাঁধটি বাঁধতে হবে। অর্থাৎ নিজকালিকাপুর থেকে রাঙ্গামাটিয়া টিলা পর্যন্ত বেড়িবাঁধ সংস্কার করতে হবে।

অগ্রগতি নেই বিদায়ী সরকারের বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের

গত ২ জুলাই ফেনীর বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেছিলেন, ‘১২২ কিলোমিটার মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নিয়ে এরই মধ্যে সমীক্ষা করা হয়েছে। দুই মাসের মধ্যে এ প্রকল্প একনেকে উপস্থাপন করা হবে।

তিনি সেদিন বলেছিলেন, খুব দক্ষ একটি টিম বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনায় কাজ করছে। বাঁধ নির্মাণে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্প অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু করা হবে।

তবে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের এক মাসের মাথায় গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের ভয়াবহ পতনের পর বাঁধ নির্মাণ নিয়ে আর কোনো আলোচনা বা প্রকল্পটির অগ্রগতির বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জাগো নিউজকে বলেন, আমি নিজে এই (সেপ্টেম্বর) মাসেই মাঠপর্যায়ে গিয়ে প্রশাসন ও এলাকাবাসীর সঙ্গে গণশুনানি করবো। তারপর করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো। অবশ্যই জনদাবির প্রতি সম্মান দেখানো হবে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে তবেই চূড়ান্ত হবে সিদ্ধান্ত।

ভারতের ত্রিপুরার লুসাই পাহাড় থেকে উৎপন্ন মুহুরী নদীটি ফেনীর পরশুরাম উপজেলার নিজকালিকাপুর এবং মাঝিরখালী গ্রামের কাছে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এটি ফেনী নদীর সঙ্গে মিশে চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলাকে পৃথক করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। এবার মাত্রাতিরিক্ত পানি হওয়ায় এবং নদীর পাড় কেটে দেওয়ায় এটি সরাসরি সাগরে না গিয়ে লোকালয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে।

এসইউজে/এমকেআর/জিকেএস