সাহিত্য

বিন্দু থেকে সিন্ধু ও অন্যান্য

এক.বিন্দু থেকে সিন্ধু

Advertisement

কত জীবনে কষ্টের বিন্দু বিন্দু জল গড়ে তোলে সিন্ধুকত জীবন নিজের ক্ষতগুলো আড়াল করে রাখেক্ষতের ওপর সৃষ্ট ক্ষতেও যাতনা প্রকাশ করে নানাগরিক জীবনে জানালার ফাঁক দিয়ে সিন্ধুতেসব জলাঞ্জলি দিয়ে কৃত্রিম হেসে বলে দেয়ভালো আছি, তোমরা স্থির যেন খুব ভালো আছি।

কষ্টের ধারাপাত পড়তে পড়তে যাদের জীবন গড়ায়তাদের কাছে জীবনের রঙ বলতে বোঝায়গ্লাসে ভরা পান-অযোগ্য জলতাদের প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসের ভাঁজে ভাঁজেকত কিছু জমা রেখে আবার নতুন জীবন খোঁজে।

কেউ কেউ জন্ম-জন্মান্তরের জমাটবদ্ধ কষ্টগুলোলুকিয়ে রেখে নতুন কষ্টগুলো আরও বেশি যত্নে পোষেপোড় খাওয়া মানুষই কেবল জানে মানুষকে কতটা ভালোবাসলেতাদের কষ্টগাথাগুলো কীভাবে অমর কবিতা হয়ে ওঠেমানুষ তো শুধু প্রাণিমাত্র নয়, তবু অসংখ্য মানুষের ভিড়েকদাচিৎ মানুষের দেখা মেলে।

Advertisement

দুই.তোমাতে বিলীন

কী বিস্ময়করভাবে তোমার আনন্দের ভেতর অনর্গল কথা বলছে আর্তনাদ কখনও কখনও আর্তনাদের ভেতরেঅপার শান্তির ছায়াও দেখেছিআবার এও দেখেছি, এই শান্তির ভেতরেই বইছে সমুদ্রের সাঁইসাঁই ঝড়আহারে, আহা; মানুষের জীবন-খতিয়ানে কত আঁকিবুঁকি!

তুমি নিশ্চয় জানো সিসিফাসের সেই গল্পটাগ্রিক পুরাণের গল্প, যা হোমারের অডিসিতে আছেসিসিফাস বেচারা একটা খাঁড়া পাথর পাহাড়ের ওপরে ঠেলে তোলে, আর পাথরটা গড়িয়ে নিচে পড়ে আবার পাথরটাকে ঠেলে ওপরে তোলে যতবার তোলে, ততবার পড়ে, কিন্তু সে বিরতি দেয় না তার অবিরাম এই একটা কাজপাথর ঠেলে পাহাড়ের চূড়ায় তোলাআর সেটা গড়িয়ে নিচে পড়লে আবার ঠেলতে থাকা।

কোনো কোনো দুঃখ অন্ধকার ঘুচিয়ে আলোর প্লাবন ঘটায় অন্তর্লোকের আগুন ছড়ায় অনন্ত দিগন্তব্যাপী অনন্ত কণ্ঠে শুনি তোমার উদার আকাশের জয়গান তুমি তো নিষ্ফলা নও, জীবনের সবকিছু দৃশ্যমান হয় না দুঃখ চাষিদের দুঃখ তোমাতেই হোক বিলীন।

Advertisement

তিন.বিপন্ন মানবতার প্রলম্বিত ছায়া

বেদনার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসাসেই আয়নাল কুর্দির কথা কি সভ্যতা-মানবতা মনে রেখেছেযে বালিতে মুখ গুঁজে সমুদ্রতীরে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল?

‘আমার সন্তানেরা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শিশু।ওরা প্রতিদিন আমার ঘুম ভাঙাতখেলা করত আমার সঙ্গেএর চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর কী হতে পারে?এ সবকিছুই হারিয়ে গেছে।’সিরীয় শিশু আয়নালের বাবা আবদুল্লাহ কুর্দিরশোকার্ত ওই উচ্চারণও কিকথিত মানবিক বিশ্ব মনে রেখেছে?

তুরস্কের সৈকতে লাল শার্ট, হাফ প্যান্ট পরানিথর আয়নাল কিছু বিবেককে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছিলঅভিবাসী-সংকট নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ইউরোপের নির্লিপ্ত নেতাদেরশেষ পর্যন্ত ঘুম ভাঙালেও এরই মধ্যেআয়নালের অনুজ গালিব আর তার মা রেহানাসহগৃহযুদ্ধকবলিত সিরিয়ার প্রায় আড়াই হাজার মানুষের প্রাণভূমধ্যসাগরে চিরতরে ডুবে গিয়েছিল!

তুর্কি আলোকচিত্র সাংবাদিক নিলুফার দেমি বলেছিলেন,‘যখন বুঝতে পারলাম ছেলেটাকে বাঁচানোর কোনো উপায়ই নেইমনে হলো ওর ছবি তুলি; বেদনাদায়ক ঘটনাটা দেখুক সবাইআশা করি, এ ছবি যে ধাক্কা দিয়েছেতা চলমান সংকট সমাধানে সহায়ক হবে।’

বালু দিয়ে আয়নালের ভাস্কর্য বানিয়ে এর মর্মস্পর্শিতারপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন ভারতীয় শিল্পী সুদর্শন পট্টনায়েক।ভাস্কর্যের পাশে তিনি লিখেছিলেন,‘ভেসে যাওয়া মানবতা... লজ্জা লজ্জা লজ্জা’।

আলোকচিত্র সাংবাদিক দেমি, ভাস্কর পট্টনায়েকতোমাদের সেই বেদনাকাতর আবেদনমেরুকরণের বিশ্বে ভূরাজনীতির সমীকরণের বৃত্ত ভেদ করে নাগাজায় চরম মানবিক বিপর্যয়েও পরাশক্তির ভোঁতা বিবেক জাগে নাইসরায়েলের জিঘাংসায় হাজার হাজার শিশু জন্মসনদের আগেইমৃত্যুসনদ নিয়ে ফের প্রশ্ন রেখেছে, এই কি সভ্যতার উৎকর্ষ আলো!

যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই- শান্তিপ্রিয়দের এ চিৎকার কে শোনেরাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ও বিশ্বের কত দেশেইবিপন্ন-বিপর্যস্ত মানবতার ছায়া প্রলম্বিত ছায়া!

এইচআর/জিকেএস