গোমতীর স্রোত: রাজমালা
Advertisement
মাছরাঙা ডানা ভাঙে অন্ধ হৃদয়েসূর্য জ্বলে যায় অপব্যয়ী কৃষ্ণমেঘে
আজ বিজয়া দশমী। আকাশের রক্তজবা রং কেটে গিয়ে ঝকঝকে নীল রং উঁকি দিয়েছে। সূর্যের আলোয় উজ্জ্বলতা।
রাজবাড়িতে আজ মহাভোজ। বাঙালি ও তিব্বতী বংশীয় ত্রিপুরা প্রজারা এসেছে রাজপ্রাসাদে। বেশিরভাগ ত্রিপুরাবাসীই তো বাঙালি। তিব্বতীয় সংখ্যালঘু। আজ সকলেই নিমন্ত্রিত রাজাতিথি। বিশ্বস্ত ও প্রিয়ভাজন সামন্তকর্তাকুল এসেছেন আজকের উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য। ব্রাহ্মণদের সেবার জন্য পৃথক ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভান্ডার থেকে চাল, ডাল প্রভৃতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যসম্ভারে ব্রাহ্মণ রাঁধুনি দিয়ে তাদের জন্য পৃথক রন্ধনব্যবস্থা করা হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশে যুবক ব্রাহ্মণ-পুত্ররা মহাউৎসাহে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অতিথিশালার কক্ষসমূহে নানা দেশ থেকে অতিথি এসেছে। ব্রাহ্মণ-পুত্ররা প্রাণ খুলে সকলের সঙ্গে মেলামেশা করছে; তারাও এই কমনীয় যুবকদের সান্নিধ্য কামনা করছে। যে যা দেয়, ব্রাহ্মণ-পুত্ররা তা-ই আহার করে, তাতে তাদের কোনো বাছবিচার নেই, যদিও এসব ব্যাপার তাদের পিতাদের জানা নেই, জানলে অনর্থ হতে কতক্ষণ!
Advertisement
অতিথিশালার এক প্রান্তে ক্ষুদ্র অপরিসর একটি কক্ষে এক ব্রাহ্মণ-পুত্রের সঙ্গে রাধারমণের সাক্ষাৎ হলো। যুবকটির শরীরাকৃতি মাঝারি এবং গাত্রবর্ণ গৌর। গোলাকার মুখমণ্ডলে চক্ষু দুটি বংশপত্রের মতো প্রলম্বিত, নাসা খর্ব। কপালে চন্দনের তিলক, মুখে হাসি লেগেই আছে; সে সব সময় যেন প্রসন্ন থাকে। কথাবার্তা চমৎকার, সুমধুর বাক্যবিন্যাস।
রাধারমণ তার নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করলে যুবকটি বলল: আমার নাম চণ্ডী দাস, বঙ্গসাম্রাজ্যে আমার নিবাস। সেখানেই মহামন্ত্র প্রচার করে থাকি। কথাটি বলার সময় চণ্ডী দাস দুই হাত জোড় করে কাকে যেন নমস্কার করলো। তারপর ব্যাকুল স্বরে প্রশ্ন করল: আচ্ছা, আমি যদি কোনোদিন মহারাজের সাক্ষাৎ পাই, তিনি কি আমাকে যুবক বলে ফিরিয়ে দেবেন? যুবকের স্কন্ধ ধারণ করে রাধারমণ বললেন: তার কাছে যুবক-প্রবীণ, পণ্ডিত-মূর্খ, ধনী-গরিব, জাত-অজাতের কোনো ভেদাভেদ নেই। তার দেখা পেলে, তোমার সুপুরুষ চক্ষুই তোমাকে তার কাছে টেনে নেবে। কিন্তু বর্তমানে তিনি উৎসব নিয়ে ব্যস্ত, তাই তার দেখা পাওয়া কঠিন।পাওয়া কঠিন! আপনি কি এটির ব্যবস্থা করতে পারেন না?
বস্তুত রাধারমণ ভীষণ বিপাকে আছেন। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা কোনোমতেই করতে পারবেন না। তাই আমতা-আমতা করে বললেন, সময় হলে তিনি নিজেই তোমাকে তার কাছে ডেকে নেবেন।রাধারমণ স্থির হয়ে বসে আছেন, কিন্তু চণ্ডী দাস অস্থির। সে মহারাজকে স্বরচিত কবিতা শোনানোর মানসে তার পিতার সঙ্গে এখানে এসেছে। তার সঙ্গে একটি তালপত্রের পুথি রয়েছে। তা তার রচিত কাব্যসম্ভার। তা থেকেই কাব্য পাঠ করে মহারাজকে শোনাতে চায় সে। সে বারবার তালপত্রের পুথিটি খুলে স্বরচিত কাব্যসমূহ দেখাচ্ছে।রাধারমণ বললেন, এগুলো কী কাব্য? শোনাও তো দেখি কতিপয়।অতি আগ্রহে পুথি থেকে পড়তে আরম্ভ করল চণ্ডী দাস: এমন পিরিতি কভু দেখি নাই, নাই শুনিপরাণে পরাণ বাঁধা আপনা আপনি।দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়াতিল আধ না দেখিলে যায় যে মরিয়া।রাধারমণ বললেন, বেশ হয়েছে!চণ্ডী দাস আবার পড়তে থাকে:এ ঘোর রজনি, মেঘের ঘটাকেমনে আইল বাটে?আঙ্গিনার কোণে তিতিছে বঁধুয়াদেখিয়া পরাণ ফাটে।রাধারমণ বললেন, উত্তম।
চণ্ডী দাসের মনে কিন্তু অসন্তোষের একটা বাষ্প জমা হচ্ছে। কী এক প্রকার সন্দেহ মনের মধ্যে উঠি-উঠি করছে। রাধারমণ কি প্রকৃতই তার কবিতা মন দিয়ে শুনছেন? ‘বেশ হয়েছে’, ‘উত্তম’ এসব মন্তব্য প্রকাশ কি কবিতার প্রকৃত মর্মগ্রহণ? তা তো তার কবিতা নিয়ে প্রকৃত আলোচনা নয়, মুগ্ধতার প্রকৃষ্ট অভিব্যক্তিও নয়। শুধু মামুলি প্রশংসা। কবিতা যদি সত্যই রাধারমণের হৃদয় স্পর্শ করত, তাহলে এইভাবে কাজচলা ধরনের মন্তব্য কি প্রকাশ করতে পারতেন? বাস্তবে কবিতা শ্রবণ করে রাধারমণ কিঞ্চিৎ সহজভাব প্রাপ্ত হয়েছেন, আর তাই অন্য কোনো মন্তব্য না করেই অতিথিশালা পরিত্যাগ করলেন। রাধারমণ প্রকৃতই কাব্যসাহিত্যের অনুরাগী, আর চণ্ডী দাসের কাব্যপ্রতিভা উজ্জ্বল। রাধারমণ যেতে যেতে মনে-মনে বলতে লাগলেন: চণ্ডী দাস বাঙলা কবিতার একজন শ্রেষ্ঠ কবি হবে। তার হৃদয়ে ভরা অসাধারণ আবেগ। তার কবিতা শ্রবণ করে আমি আবেগের স্রোতে ভেসে যাচ্ছি। এই আবেগ কৃত্রিম নয়, ফিকেও নয়; টসটসে আবেগ।
Advertisement
ভুল বুঝিস না বন্ধু আমারবেলা যে হয়ে উঠছে ভয়ংকর
চন্দ্রবংশীয় মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদের অলিন্দে রাজসভাসদ পরিবৃত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, যেন তার উপস্থিতিতে পূর্ণমর্যাদায় পালিত হয় মহাভোজ। তিনি মাঝারি উচ্চতার একজন বলিষ্ঠ সুপুরুষ। আকৃতিই শুধু নিখুঁত নয়, বিস্ময়কর তার মুখের সারল্যও। প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মুখমণ্ডলে প্রথমেই চোখে পড়ে নাকের নিচের অতি পুরুষ্টু ঠোঁট দুটি। বয়সের বিচারে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেছেন তিনি। তবুও কিছুক্ষণ আগে, দীর্ঘপথ অশ্বচালনা করে ফিরেছেন। রাজবংশের প্রথা অনুযায়ী তিনি নবমীর রাত্রিতে উদয়পুরে ত্রিপুরাসুন্দরীর মন্দিরে পুজো দিতে যান। মহাভোজের সময় তাঁকে উপস্থিত থাকতে হবে বলেই তিনি কিছুক্ষণ আগে ফিরে এসেছেন।
রাজপ্রাসাদের সামনে বিসর্জনের বাজনা শুরু হয়েছে। প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রায় অবশ্য মহারাজ স্বয়ং অংশগ্রহণ করবেন না, মঙ্গলঘট বহন করে নিয়ে যাবেন তার জামাতাদ্বয়—শশিভূষণ ও উদীয়মান, কেননা তার কোনো পুত্রসন্তান নেই। এই পর্ব শেষ হওয়ার পর, মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য প্রজাদের সঙ্গে অন্ন—খিচুড়ি আর পায়সান্ন—গ্রহণ করবেন, মৃত্তিকায় এক পঙ্ক্তিতে বসে। এই পঙ্ক্তি-মহাভোজের দিন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য রাজবেশ ধারণ করেন না, মাথায় রাজমুকুটও থাকে না, তাই তিনি সেজেছেন পট্টবস্ত্রে। সকলের খাওয়া শেষ হতে হতে রাত্রি ভোর হবে। আর এই মহাভোজের মাঝেমধ্যে চলবে নৃত্য-গীত-যাত্রাপালা। যাত্রপালা মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের খুবই প্রিয়। কিন্তু আজকের রাত্রিটি মহারাজের কাছে যেমন আনন্দের তেমনই সংকটেরও বটে। আগামীকাল প্রজাবৃন্দের সামনে তিনি ভবিষ্যৎ রাজার নাম ঘোষণা করবেন। মহারাজের বয়স হয়েছে, রাজ্যশাসনের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে চান তিনি।
মণিপুরের যুবরাজ নিত্যানন্দ আজকের রাত্রিতে রাজনিমন্ত্রিত অতিথি। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের আদেশে এসেছে সে। আসার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের আদেশের পরিপন্থি কোনো কিছু করাও সম্ভব নয়। অনেক যুদ্ধে সে এরই মধ্যে অভূতপূর্ব পারদর্শিতা দেখিয়েছে। ছোটখাটো কিছু যুদ্ধ জয় করে ইতোমধ্যে একজন প্রকৃত ক্ষত্রিয় ও বীরযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছে। তার সঙ্গে এসেছে জনচারেক মণিপুরি সৈন্য। যুবরাজ নিত্যানন্দ একাই আসত, কিন্তু সময়টা অনুকূল নয়, তাই সঙ্গে আনতে হয়েছে সৈনিকদের। যে কোনো মুহূর্তে, যে কোনো দিক থেকে বর্মণ দস্যুরা ঘিরে ফেলতে পারে। এই তো দিনকয়েক আগেও মণিপুরের সীমান্তে তারা আক্রমণ চালিয়েছিল।
মুখোমুখি দুই সারি আসন পাতা হয়েছে। সারি দুটির এক প্রান্তে যুবরাজ নিত্যানন্দের আসন। ডানে ও বাঁয়ে, দুই দিকেই কথা বলা যায়, মাথা না-ঘুরিয়ে। দুই সারির মাথা যেখানে মিলেছে, এই কেন্দ্রস্থলে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বসেছেন।
কারুকার্যমণ্ডিত বিচিত্র আকারের কাঁসা ও রুপোর তৈজসপত্র ঝকঝক করছে। ভৃত্যবৃন্দ খাবার পরিবেশন করে গেছে। মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সেরা খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। বঙ্গসাম্রাজ্যের সুগন্ধি সরু লালচালের ভাত, সোনারং ঘিয়ের সুবাস, রুপোর ছোট ছোট বাটিতে সাজানো বিভিন্ন রকম শাকসবজি, ঝোল থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম তরকারি, কয়েক পদ ডাল—বিচিত্র খাদ্যের জাঁকজমক ও পানীয়ের বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্য অতিথিদের অভিভূত করছে। ভোজের অঢেল সমারোহ যে-কারও চোখ জুড়িয়ে দেওয়ার মতো।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য ভোজপর্ব শুরু করার আহ্বান জানালেন। তার প্রশস্তি গেয়ে ঝকঝকে কাঁসার থালায় হাত রাখলেন সবাই। খেতে বসে অন্যদিকে মন দেওয়া উচিত হচ্ছে না ভেবে, শশিভূষণ ও উদীয়মানের দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে যুবরাজ নিত্যানন্দ। খাবারের প্রতি শশিভূষণ ও উদীয়মানের এমন অখণ্ড মনোযোগ দেখে একটু অবাক হতেই হলো যুবরাজ নিত্যানন্দকে।
বঙ্গসাম্রাজ্যের বিশদ খবরাখবর সংগ্রহ করে এনেছে শশিভূষণ ও উদীয়মান। একান্তই গোপনীয় নয় যেসব সংবাদ, সেগুলো নিয়ে পরামর্শ করছে উভয়। তাদের কথাই শুনছে যুবরাজ নিত্যানন্দ। সে চলনে, বলনে, খাদ্যাভ্যাসে, আচারাচরণে পুরোপুরি বাঙালি হয়ে উঠেছে। বাংলা কবিতা তাকে আবেগাপ্লুত করে। নিজেও বাংলায় কবিতা রচনা করছে। তাই শশিভূষণ ও উদীয়মানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রশংসাসূচক শব্দ ঝরে পড়ে তার ঠোঁট থেকে: বাহ্, উপযুক্ত কবিতা রচনা করেছেন জয়দেব। শব্দবাহুল্য নেই। তিনি কোনো কাব্য করেননি, যা বলার সবই বলেছেন সহজ ভাষায়। আশা করি তোমরাও পড়েছ জয়দেব? শশিভূষণ বলল, বাংলা কবিতা নয় যুবরাজ। বঙ্গসাম্রাজ্য জয় করাই আমার বাসনা। যুবরাজ নিত্যানন্দ সচমকে শশিভূষণের মুখের দিকে তাকাল। দেখল, শশিভূষণের মুখে আত্মগরিমার কী এক প্রকার আভা খেলা করছে। তার অধরোষ্ঠ দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় সংবদ্ধ হয়ে আছে। শশিভূষণের মুখে দৃষ্টি রেখেই যুবরাজ নিত্যানন্দ বলল: জয়ের পরই তাহলে ত্রিবেণীতে নৌবিহার হবে। পুরো পূর্ণিমাতিথিব্যাপী চলবে কাব্যচর্চা। পানভোজন, নৃত্যগীত, ক্রীড়াকেলি, আমোদ-প্রমোদ—যা চাও তারই আয়োজন করা হবে তোমার জন্য।ঠিক আছে যুবরাজ।যুবরাজ আর কোনো কথা বলতে চাইলো না।
মহাভোজ শেষে মহারাজের বিশ্বস্ত ও প্রিয়ভাজন সামন্তকর্তাবৃন্দসমেত শশিভূষণ, উদীয়মান ও নিত্যানন্দ বিলাসগৃহে এসে প্রদীপের স্তিমিতালোকে শরীর এলিয়ে দিলো। উন্মুক্ত বাতায়ন পথে গোমতী নদীটিকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। আকাশ তার গভীর চোখে গোমতী নদীর ব্যাকুলতা দেখছে। নৌকার যাত্রীদল, মাঝিমাল্লা এই রাত্রে নিকটবর্তী নদীতটভাগে নেমে রাত্রিযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ঠিক তখনই প্রকৃতি মেঘমালা পাঠিয়ে আকাশকে অন্ধকার করে ফেলে, তারপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামতে শুরু করে, একই সঙ্গে নর্তকীদের কোমল চরণে বেজে ওঠে নূপুর। নিক্বণে ঝংকৃত হয় বিলাসগৃহ। ঢোলের বিচিত্র বোল অপার্থিব জগতে নিয়ে যায় সকলকে। তারপর গভীর রাত্রে স্খলিত চরণে ঘরে ফিরে যায় মহারাজের বিশ্বস্ত ও প্রিয়ভাজন সামন্তকর্তাবৃন্দ।
খুঁজে ফিরে জলের ভাঁজে বাঁশির সুরমুছে দিতে অবিশ্রান্ত চুম্বনেঅন্ধকার, সত্য উন্মোচনে
প্রভাতে ঘুম থেকে উঠে গোমতী নদীতটে ভ্রমণে বের হলো যুবরাজ নিত্যানন্দ। দেখা হয়ে গেল রাজকবি রাধারমণের সঙ্গে। তার সঙ্গে সহজ আলাপে মেতে উঠল নিত্যানন্দ। রাধারমণের আচরণে এক ধরনের উদাস-উদাস ভাব রয়েছে। কবিতা রচনা করেন তিনি বাংলা ভাষায়। তার কবিতার সৌন্দর্য ও ভাব নিত্যানন্দকে মোহিত করে।
এক ফাঁকে গতরাত্রির শশিভূষণের বঙ্গসাম্রাজ্য জয়ের আলোচনা শুরু হয়। নিত্যানন্দ বিশেষভাবে লক্ষ্য করে যে, রাধারমণের মন্তব্যের অনেক ক্ষেত্রে তার অভিমতের মিল রয়েছে। কার্যকারণ বিবেচনা করে, অনেক ভেবেচিন্তে কথা বলছেন রাধারমণ। বঙ্গসাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযানে তার কোনো সায় নেই। নিত্যানন্দ জিজ্ঞেস করল, আপনার এমনটা ভাবার কারণ কী রাজকবি? ত্রিপুরা তো বঙ্গসাম্রাজ্যের মাটিতেই শেকড় ছড়িয়ে রয়েছে, স্বাভাবিক নিয়মে। এখন অবশ্য ত্রিপুরার বিস্তৃতি প্রয়োজন।ত্রিপুরার বিস্তৃতি কিংবা সম্প্রসারণের বিপক্ষে নই আমি, যুবরাজ। কিন্তু প্রতিক্রিয়া কী হবে তা একবার ভেবে দেখুন। কিছু মনে করবেন না, পূর্বদেশীয় ত্রিপুরার মহারাজরা যদিও বঙ্গীয় মাটিকে নিজেদের করে নিয়েছেন, তবুও বঙ্গীয় মৃত্তিকা বঙ্গীয় জনগোষ্ঠীরই। তারা ভারতবর্ষের উত্তরাংশসমেত সমগ্র আর্যাবর্ত নিজেদের অধীন নিয়ে এসেছে। এখন কিছুটা দুর্বল হলেও ত্রিপুরা কিংবা মণিপুর দখল করা তাদের পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয়। যে-জাতি মহাবীরদের জন্ম দিয়েছে সেই জাতি যে এখনো দিতে পারবে না, তা ভাবাও সঠিক নয়। তাই বঙ্গসাম্রাজ্য জয়ের আশা ত্রিপুরা কিংবা মণিপুরের করা উচিত নয়।শুধু ত্রিপুরা কিংবা মণিপুরই নয়, ভারতবর্ষের দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলের সঙ্গেও বঙ্গসাম্রাজ্য যুদ্ধ করেছে।আজ্ঞে, এসব যুদ্ধে লাভ হয়েছে কার? বঙ্গসাম্রাজ্যের। বাকিদের শুধুই ক্ষতিসাধন। হাজার হাজার বছরে বঙ্গীয় জনগোষ্ঠী গড়ে তুলেছে সভ্যতা, কৃষ্টি, সমাজ, ধর্ম, সাম্রাজ্য। আমার এমন বক্তব্য ও ঔদ্ধত্য ক্ষমা করবেন যুবরাজ।আপনার দুশ্চিন্তার কারণ বুঝতে পারছি আমি, রাজকবি। মোটেই অমূলক নয় আপনার মন্তব্য। যুক্তিসংগত ও যথার্থ। আমাকেও ভাবনায় ফেলে।জানেন তো যুবরাজ, আর্যাবর্ত যাদের হাতে তারাই ভারতবর্ষের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পারে। বঙ্গসাম্রাজ্য কিছুটা দুর্বল বলে যারা তাকে আক্রমণ করার চিন্তা করে তারা নিঃসন্দেহে পরাজিত হবে। মনে রাখতে হবে, বঙ্গসাম্রাজ্যকে পরাজিত করতে চাইলে সমগ্র ভারতবর্ষের ওপর আক্রমণ করতে হবে। যদি কেউ এমন আক্রমণ করে বঙ্গসাম্রাজ্য ধ্বংস করতে চায়, তাহলে সমগ্র ভারতবর্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই আমার উদ্বিগ্নের কারণ, যুবরাজ। বঙ্গসাম্রাজের পরাজয় মানেই সমগ্র ভারতবর্ষেরই পরাজয়।আপনার একথা ভেবে দেখার মতো, রাজকবি। রাজারা সবাই চাইছেন আধিপত্য, নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি।ভারতবর্ষে তেমন শক্তিশালী কেউ নেই যে, বঙ্গসাম্রাজ্যকে পরাজিত করতে পারেন। তাই আমার অভিমত, বঙ্গসাম্রাজ্যের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ব ও সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলাই আবশ্যক। আপনি ঠিক বলেছেন, যুদ্ধের সুযোগ থাকলে আলোচনারও সুযোগ থাকে। ত্রিপুরা কিংবা মণিপুর রাজ্যদ্বয় দ্বিমুখী সংঘাতেই অভ্যন্তর থেকে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। শত শত বছর ধরে এরকমই হয়ে আসছে। এতকাল ছিল নিজেদের কর্তৃত্বের সংগ্রাম। এখন নিজেদের অস্তিত্ব অন্যদের হাতে বিলিয়ে দেওয়ার উপক্রম হয়েছে। ক্ষমা করবেন যুবরাজ, বর্তমান পরিস্থিতি ও প্রেক্ষিতের পার্থক্যটা বুঝতে হবে আপনাকে। আমার মতো নগণ্য একজন রাজকবির ভাবনা কেন, সাধারণ প্রজাদের ভাবনারও কোনো মূল্য নেই রাজাদের কাছে। কোটি মানুষ শুধু অনুসরণ করে তাদের। একটু থেমে কী যেন কী ভেবে নিয়ে যোগ করলেন, এই প্রসঙ্গটা আজ থাক, যুবরাজ।আপনি চাইলে বলতে পারেন, আমি শুনছি।ত্রিপুরা ও মণিপুর বর্মণদের নিয়েই চিন্তা করা উচিত। তাদেরই পূর্বদেশীয় প্রবেশপথ তৈরি করে দিচ্ছে ত্রিপুরা ও মণিপুর। তাদের ইতিহাসটা একটু দেখুন, যুবরাজ। তেমন শক্তিশালী কেউ নয় তারা। মারখাওয়া, পলাতক, ভাগ্যান্বেষী, চরিত্রহীন, লোভী ও নিয়মনীতিবর্জিত একদল ভবঘুরে যোদ্ধা। যুদ্ধের-পর-যুদ্ধ করে চলেছে শুধু লোভের বশবর্তী হয়ে। তাদের বরং সংঘবদ্ধ ডাকাতদল বলা যায়।রাধারমণের চোখের দিকে তাকিয়ে নিত্যানন্দ বলল, সত্যিই ভাবিয়ে তুলছেন, রাজকবি।মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলেন রাধারমণ, ভাবনার বিষয়ই যুবরাজ। প্রকৃতি রহস্যময়। তাই সত্য ধীরে ধীরে প্রকাশিত হবে।
রাধারমণের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে গোমতীর ঘাটে এসে দাঁড়াল নিত্যানন্দ। ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাস এসে কোনো এক অচেনা আবেশে জড়িয়ে ধরল তাকে। দূর থেকে ভেসে আসছে একটি কোমল বাঁশির সুর। মানুষ ভাবতে কষ্ট হয় নিজেকে, তবুওসূর্যলুপ্ত হিমশর্বরীতে ভেঙে চলেমাথাভাঙা বনবীথির পথ।
চলবে...
আগের পর্ব পড়ুন
গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০১ গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০২ গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৩ গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৪এসইউ/এমএস