জাতীয়

‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ গঠিত, জানালেন নানান দাবি

বৈষম্য নিরসনে প্রশাসন ছাড়া বাকি ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত হলো ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’।

Advertisement

শনিবার (৩১ আগস্ট) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক সংবাদ সম্মেলনে পরিষদ গঠনের কথা জানান কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে তারা বৈষম্য নিরসনে নানান দাবি তুলে ধরেন।

তারা উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে নিয়োগে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ এবং মেধার যথাযথ মূল্যায়ন ও বৈষম্যহীন জনবান্ধব সিভিল প্রশাসন গড়তে সিনিয়র সার্ভিসেস পুল (এসএসপি) প্রথা ফের চালুর দাবি জানান।

একই সঙ্গে তারা ‘ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার’ প্রথা চালু, সব ক্যাডারের মধ্যে সমতা আনা, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন করে গ্রেডভিত্তিক সমতা আনার দাবি জানান।

Advertisement

কর্মকর্তারা বলেন, সরকারের অংশ হিসেবে প্রজাতন্ত্রের সব সেক্টরের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দেশের সিভিল প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে চাই। সে লক্ষ্যে ২৫টি ক্যাডারের সমন্বিত কর্মকাণ্ডকে সাংগঠনিক কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালনার জন্য গঠিত হয়েছে ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’। যার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হচ্ছে আজ থেকে। এই সংগঠনের মাধ্যমেই যে বিষয়গুলো জনবান্ধব ও জনকল্যাণমূলক সরকার গঠনের অন্তরায়, সেগুলো সবার সামনে উত্থাপন করছি।

তারা বলেন, আমরা সরকারের পাশে থেকে সব ধরনের সহযোগিতার মাধ্যমে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই। সরকারকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে চাই।

উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে কোটা পদ্ধতি

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগের নিউক্লিয়াস হলো এর ক্যাডার সার্ভিসগুলো। এর ওপরে রয়েছে সরকারের সুপিরিয়র সার্ভিস যা উপসচিব হতে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত বিন্যস্ত। স্বাধীনতার পর সংসদে ‘সার্ভিসেস (রিঅর্গানাইজেশন অ্যান্ড কন্ডিশনস) অ্যাক্ট, ১৯৭৫’ করে কর্মবিভাগ তৈরির জন্য সরকারকে ক্ষমতা দেওয়া হয়। এই আইনের অধীন ১৯৭৯ সালের ১ মার্চ সিনিয়র সার্ভিসেস পুল (এসএসপি) আদেশ জারি করা হয়। এখন ক্যাডারের সংখ্যা ২৬। এসএসপি এবং ক্যাডার সার্ভিস ছিল একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো এসএসপি আদেশ কখনই বাস্তবায়ন করা যায়নি। সচিবালয়ে অবস্থানগত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসন ক্যাডার এই সার্ভিসটিকে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৯৮৯ সালে এসএসপি বাতিল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ১০ বছরে একবারের জন্যও পরীক্ষার মাধ্যমে উপসচিব নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি।

১৯৯৮ সালের ১০ ফ্রেব্রুয়ারি একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে (১১ ফেব্রুয়ারি গেজেট নোটিফিকেশন জারি হয়) উপসচিবের পদে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৭৫ শতাংশ কোটা রেখে অন্যান্য ক্যাডারের জন্য ২৫ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রাখা হয়।

Advertisement

এ বিষয়ে মামলাও হয়। মামলার রায় অনুযায়ী ও বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বৈষম্য দূর করে নতুন আদেশ করার ক্ষেত্রে কোনো বাঁধা নেই। কিন্তু এখনো সেই কোটা পদ্ধতি ভালো রয়েছে। মেধার যথাযথ মূল্যায়ন ও বৈষম্যহীন জনবান্ধব সিভিল প্রশাসন গড়তে এসএসপি প্রথা ফের চালু করে, মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, একটা ক্যাডারভুক্ত সদস্যরাই অভিজ্ঞতা অর্জন ও পদোন্নতির মাধ্যমে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ ধাপ পর্যন্ত যাওয়ার অধিকারী হবেন। যেমন- স্বাস্থ্য ক্যাডার থেকে স্বাস্থ্য সচিব হবেন। সংশ্লিষ্ট বিভাগের সমস্যার খুঁটিনাটি, সমাধান কৌশল, সময় উপযোগী নীতি নির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন কৌশল সংশ্লিষ্ট ক্যাডার কর্মকর্তারা যেভাবে বুঝতে পারবেন, অন্য কোনো ক্যাডার কর্মকর্তাদের পক্ষে সেটা জানা সম্ভব নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের প্রতিটি সেক্টরের নীতি নির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করছেন অনভিজ্ঞ, অদক্ষ ও অপেশাদার প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পথে এটিই মূল অন্তরায়।

সব ক্যাডারের মধ্যে সমতা আনা

সরকারের পাশে থাকার সুবাদে সব ক্যাডারকে অবহেলিত করে প্রশাসন ক্যাডার এককভাবে সরকারের কাছ থেকে অধিক সুবিধা নিয়ে থাকে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, উদাহরণ স্বরূপ- ২০১৫ এর পে-স্কেলে শ্রেণিভিত্তিক অবস্থানের পরিবর্তে গ্রেডভিত্তিক অবস্থানের কথা বলা হলেও কেবল উপসচিবদের গাড়ি ক্রয়ের জন্য এককালীন ৩০ লাখ টাকা ধার দেওয়া এবং সেই গাড়ি পরিচালনার জন্য মাসিক ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের পদোন্নতির ক্ষেত্রে দেখা যায় একমাত্র প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিয়মিত পদোন্নতি হয়, পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি দিতে সুপার নিউমারি পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু অন্য ক্যাডার কর্মকর্তারা পদোন্নতির সব যোগ্যতা অর্জন করেও দীর্ঘদিন পদোন্নতির অপেক্ষায় থাকেন। অন্য সব ক্যাডারের পদোন্নতি প্রশাসন ক্যাডারের দয়ার ওপর নির্ভরশীল।

ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন

ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বা পদমর্যাদাক্রম হলো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের পদের ক্রমবিন্যাস। যার মাধ্যমে তাদের প্রটোকল বা সুপিরিয়রিটি নির্ধারিত হয়। প্রশাসন ক্যাডারের নিজেদের সুবিধামতো এটি বারবার সংশোধনের ফলে চরম বৈষম্য তৈরি হয়েছে। এ কারণে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলোতে দেখা যায় কোনো ক্যাডারের নবম গ্রেডের কর্মকর্তা প্রটোকল পেলেও অন্য ক্যাডারের চতুর্থ বা তৃতীয় গ্রেডের কর্মকর্তারা অবমূল্যায়িত হন। ফলে অন্যান্য ক্যাডারের ব্যক্তিত্ববান কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন করে গ্রেডভিত্তিক সমতা আনয়ন প্রয়োজন।

বিভিন্ন ক্যাডারের তফসিলভুক্ত পদ থেকে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার এবং উপজেলা/জেলা/বিভাগীয় পর্যায়ে আয়োজিত অনুষ্ঠান/সভা/সেমিনার ইত্যাদিতে ইউএনও/জেলা প্রশাসক/কমিশনারের পরিবর্তে আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠানের সভাপতিত্ব করার বিধান চালু করারও দাবি জানিয়েছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ বেতারের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এ এস এম জাহিদ, শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান, তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা মনির হোসেনসহ অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে সহযোগী অধ্যাপক ফারহানা আক্তার দাবিগুলো উপস্থাপন করেন।

আরএমএম/ইএ/জেআইএম