মতামত

ঘুসের ঘুণ পোকারা চরিত্রে পঙ্গপাল

সম্প্রতি কিছু দুর্নীতিবাজ গ্রেফতার ও অনেকের দেশ ছেড়ে পালানোর ধরন দেখে মনে হয় নীরব ঘুস-দুর্নীতির এক সরব বিপ্লব ঘটেছিল। দেশের সততা ও নৈতিকতার ভিত্তি ভীষণভাবে নড়বড়ে করে দিয়েছে নানা ধরনের দুর্নীতিবাজরা। ঘুস-দুর্নীতির কোনো রাখঢাক ছিল না, ছিল না কোনো ঘৃণা বা ধিক্কার। তাই ঘুসের চাষাবাদ বাম্পার ঘুসফল উৎপাদনের টার্গেট পূরণ করেছে! এখন এর পরিসমাপ্তি ঘটানো দরকার।

Advertisement

কারটা লিখব? কোন সেক্টর ঘুসবিহীন কাজ করে? শিক্ষা সেক্টরকে পবিত্র বলে গণ্য করা হয়। সাধারণত সেখানে দুর্নীতি করার উপায় নেই। কিন্তু এই সেক্টরে গ্রামের একজন নিরীহ স্কুলশিক্ষক জায়গামতো ঘুস না দিলে পেনশনের টাকা পাবেন তার কোনো নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবেন? সারা জীবন সৎ থেকে একজন ভুক্তভোগী বৃদ্ধ শিক্ষকের আকুতি- বাবারে, আমি কয়দিন বাঁচবো? আমাকে হেড অফিসে ঘুস দিয়ে পেনশন পাস করাতে বলো না। না খেয়ে মরবো, ‘তবু জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে চাই না।’

তার মতো মহান শিক্ষকের এত পবিত্র উপলব্ধি তো আমাদের সমাজে সবার নেই। আমাদের আর্থ-সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ঘুস লেনদেনের প্রতি এতটাই বেপরোয়াভাবে আকর্ষিত হয়ে পড়েছে যে তার থেকে মুক্তি পাওয়া খুব কঠিন। একশ্রেণির মানুষ পেটের দায়ে বাঁচার জন্য চুরি, ছ্যাঁচড়ামি করে অর্থ আয় করে তাদের কথা আলাদা। কারণ সমাজে এদের সংখ্যা অনেক কম।

কিন্তু পদধারী, ক্ষমতাধারী লোভী মানুষেরা যখন চুরি, জালিয়াতি, মিথ্যাপনা, দখলবাজি, ছলনার মাধ্যমে ঘুসের জাল বিস্তার করে চাকরি, পদোন্নতি, বদলি, ছুটি, পেনশনপ্রত্যাশী নিরীহ অথবা বেকার মানুষকে সহজে ফাঁদে ফেলে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করে এটাই ঘুস। এটাই দুর্নীতির মহামারি। যে কোনো পদে নিয়োগদান থেকে শুরু করা যাক। ভোট থেকে শুরু করতে পারলে ভালো হতো। যে কোনো পর্যায়ে নির্বাচনের সময় আমাদের দেশে মতো এত হইচই, মারামারি, খুন-খারাবি, ভোট চুরি, জালিয়াতি, কেন্দ্র দখল, প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ঘটে বলে মনে হয় না। এই প্রবন্ধে এসব নিয়ে কিছু বলতে চাই না। শুধু সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন পদে নিয়োগদান থেকে শুরু করি।

Advertisement

সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুসন্ধানে ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রশ্নফাঁস নিয়ে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। গত ১২ বছরে ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠে। এসব ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন অনেকেই। তাদের অনেকে এখন বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরিও করছেন। যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে চাকরি করছেন প্রশ্নফাঁসকাণ্ডে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসার পর তারাও আতঙ্কে রয়েছেন।’ গত ৩০টি পাবলিক চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিক্রির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করা হয়েছে।

‘গত ১২ বছরে বিসিএস পরীক্ষাসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী। ঢাকায় একটি ছয়তলা বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ি রয়েছে তার। আর গ্রামের বাড়িতে রয়েছে ডুপ্লেক্স বাড়ি। সিআইডি জানিয়েছে, অন্তত ৫০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক।’

‘পিএসসির প্রশ্নফাঁস শুরু হয় আগে থেকেই। গত ২৪তম ব্যাচে ব্যাপকতা বাড়ে। পরে ২৫তম ব্যাচে প্রশ্নফাঁস বিষয়টি ধরা পড়ে। তার নেতৃত্বে একটি গ্রুপ থাকতো। তারা কাস্টমার জোগাড় করে দেওয়ার দায়িত্বে ছিল। তার হাত ধরে অনেকেই হয়েছেন বিসিএস ক্যাডার। সব ক্যাডারেই রয়েছেন তার লোক। আবেদ আলীর হাত ধরে যারা বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন, তাদের তালিকা প্রণয়নের কাজ থেকে শুরু করেছে একটি সংস্থা।’ফাঁস হওয়া প্রশ্নে তিনজন বিসিএস ক্যাডারের নাম প্রকাশ করেছেন গ্রেফতার করা একজন ডেসপাস রাইটার।

এছাড়াও সম্প্রতি আলোড়ন তুলেছে দুর্নীতির দায়ে সম্প্রতি ওএসডি হওয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের সম্পত্তির তথ্যও। মেগা-দুর্নীতির এই তালিকায় রয়েছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদও। এর ব্যাপক বিস্তার ও অনুশীলণ সমাজকে বৈষম্যের মুখোমুখি করে সামাজিক ভাঙন সৃষ্টি করে। ফলত সামজিক আন্দোলন সূচিত হয়ে অশান্তি তৈরি হয়। যেটা এই মুহূর্তে আমাদের সমাজে ব্যাপক অশান্তির তরঙ্গ তৈরি করে মানুষকে হতাশায় ভাবিয়ে তুলেছে।

Advertisement

‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি ছবি পোস্ট করেছে। ছবিতে একজন বাবাকে শিশুদের মতো হামাগুঁড়ি দেওয়া অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। সাথে লেখা, আপনার বাবাকে ‘টিকা’ দিন। বাস্তবে, এই টিকা কোনো রোগ প্রতিরোধের জন্য নয়, বরং দুর্নীতি প্রতিরোধে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা, ‘দুর্নীতি প্রতিরোধে আওয়াজ উঠুক ঘর থেকে; বাবাকে টিকা দিন, দরকার হলে নিজেও নিন।’

বাংলাদেশে চোরের খনি এটা কোনো নতুন কথা নয়। সাবেক একজন মন্ত্রীর মতে ঢাকায় একটি বাড়িও বৈধ নয়। পেশাদারি চোরের ওপর পেশাদারি বাটপারি করা নতুন কিছু নয়। কুমিল্লার এক অফিসের একজন পেশকার ক’বছর আগে একটি উক্তি করেছিলেন। তিনি এক মামলায় হাজিরা দিতে এলে ঘুসের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন ‘বস এত খায় আর আমি সামান্য খেলে দোষের কি দেখলেন?’ তার মন্তব্যটি শুনে সেদিন সবাই হতবাক হয়েছিল। পরদিন এটি সংবাদের শিরোনাম হলেও পরে এনিয়ে আর কোনো প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।

‘ফাঁসকরা প্রশ্ন বিক্রির টাকা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেছি।’ এসব কি কথা? এটা কি আমাদের সামাজিক শিক্ষা? আসলে ভোট চুরি, মেগা অপরাধীদের দলীয় প্রশ্রয়, মাদক সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতা দান দেখে সাধারণ মানুষ নিজেরা দুর্নীতি করতে ভয় পাচ্ছে না। এটাই আমাদের দেশের ব্যতিক্রমী সামাজিক শিক্ষা হয়ে উঠেছে।

দেশে ৪০ শতাংশেরও বেশি শিক্ষিত বেকারত্ব, চাকরির বাজারে আকাল, ঘুস ছাড়া নিয়োগ নেই, ইত্যাদির কথা কে কাকে শোনাবে আর কে শুনবে? তাদের দাবি বা আহাজারি শুনে কর্তৃপক্ষের কারো কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত নেই। সংসদে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সরকার ও সংসদ সদস্যরা, ব্যবসায়ী ও বিত্তশালী সবাই একাকার। সেখানে বিরোধী দল থেকেও নেই। বঞ্চিতজনের কথা বলার ও শোনার কেউ নেই। এটাই আমাদের দেশের একদলীয় শাসনের সুবিধা ও অসুবিধা উভয়েরই একচ্ছত্র নিয়ামক!

সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি শোনার মতো কেউ নেই। শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি জোর করে অযৌক্তিক বলে অমর্যাদা করতে কেউ কেউ দ্বিধা করে না। কারণ, কারো প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে যৌক্তিক পথে তারা দায়িত্বে বসেনি। যারা তাদের দায়িত্বে বসার সুযোগ করে দিয়েছিল তাদের তারা অবাধ দুর্নীতি করার সুযোগ দিয়ে সুতোয় টান মেরে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে। এমন একটি নাজুক আর্থ-সামাজিক ও কর্কশ পরিস্থিতিতে ভালো কথা বা নীতিকথা কারো কর্ণকুহরে প্রবেশ করানো কঠিন।

ফলে দুর্নীতি বেড়ে যাচ্ছে। পোষা বিড়ালকে মাথায় তুলে আদর করায় তারা বেপরোয়া হয়ে দুর্নীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মাছ খেতে দিয়ে হঠাৎ কেড়ে নিতে চাইলে বিড়াল গোস্বা করে পাতে কামড় বসাতেই পারে। মাথায় ওঠায় তারা আর ইঁদুর ধরে না। বরং নিজেরাই ইঁদুরের সাখে খেলা করে, ভোজ করে। রক্ষকরাই এখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। যার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছিল অস্থির সমাজের বাজারের অগ্নিমূল্যে ও গত জুলাইয়ে বেকারদের বাংলা ব্লকেডে।

ঘুণপোকারা পিএসসিতে কবে থেকে সক্রিয় সে খবর কি কেউ জানেন? এই চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানটিকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে কারা জর্জরে করে ফেলেছে তাদের কি চিহ্নিত করা হবে? গত এক যুগে প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে ঘুস দিয়ে ভয়ংকর ঘুণপোকা তৈরি হয়ে চারদিকে ছারখার করে তুলেছে। তারা আজ কে কোথায় চাকরি করছেন সেটা খুঁজে বের করবে কোন বিড়াল, কোন থাবা নিয়ে?

ঘুণপোকারা পিএসসিতে ও শীষকাটা লেদাপোকারা আরো বড় জায়গায় থেকে ডিম পেড়ে বংশবদ তৈরি করে চক্র তৈরি করেছে। তারা চক্র থেকে ভয়ংকর সর্বগ্রাসী পঙ্গপালের রূপ নিয়ে দেশের সম্পদ গ্রাস করে পাচারের কাজে লিপ্ত হয়েছে। এখন তাদের তদন্ত করে খুঁজে করবে কে? মেগা-পাহারাদাররা চুরি-ডাকাতি করে দেশ ছেড়ে পলায়ন করছে। ট্রেজারির খাজাঞ্চিরা আত্মগোপন করে আছে। তাদের সহায়তাদানকারীরা বড় গলায় কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কাজে লিপ্ত রয়েছে।

মেগা-পাহারাদাররা বিপদে পড়ায় আরো অবৈধ বিত্তের দাপটে বিভোর যারা তাদের চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছে। তারাও পলায়ন করতে উদ্যত হয়ে উঠেছে। ব্যাপকভাবে দুর্নীতির চাষাবাদের এ সময়ে নড়বড়ে হয়ে উঠছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, সামাজিক নিরাপত্তা, চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানসহ সব সেবাঙ্গন।

ঘুসের ঘুণপোকারা ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপালের মতো চারদিকে গ্রাস করে অস্থির করে তুলেছে জনজীবন। হরণ করে ফেলেছে নিরীহ শান্তিকামী মানুষের ঘুম, সুখ-শান্তি সবকিছু। নিত্যপণ্যের বাজারে দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় স্ফীতি ও অভাবের সাথে সামঞ্জস্যবিধান করতে না পেরে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঘুস পোকার পঙ্গপাল চরিত্রের গ্রাসে আক্রান্ত হয়ে চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়েছে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গন। নতুন সরকার তথা অন্তর্বর্তী সরকারের এই জ্বলন্ত ইস্যুর দিকে নজর দেওয়ার সময় হলে দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হতে পারে।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/এমএস/ফারুক