ফেনী সদর উপজেলার সত্তরোর্ধ্ব প্রিয়বালা বর্মণ আগে থেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত। দারিদ্র্যের কারণে খুব যে বেশি চিকিৎসা করাতে পেরেছেন তা নয়। ২১ আগস্ট বিকেল থেকে যখন পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের ভগবানপুর গ্রামে পানি প্রবেশ করতে থাকে, তখনই সবাই প্রমাদ গুনতে থাকেন। সন্ধ্যার পর থেকেই প্রিয়বালাদের উঠান ডুবে পানি ঘরে ঢুকে পড়ে।
Advertisement
রাত বাড়তে থাকলে ঘরে পানিও বাড়তে থাকে। প্রিয়বালাকে নিয়ে ছেলে সুকুমার চন্দ্র বর্মণ, তার স্ত্রী ও সন্তানরা ঘরে অবস্থান নেন। মাকে পানি থেকে বাঁচাতে ঘরের মধ্যে মাচা করে সেখানে রাখেন ছেলে।
বানের পানিতে এই অবস্থায় খেয়ে না খেয়ে ছয়দিন থাকার পর প্রিয়বালা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মায়ের শরীর খুব খারাপ অবস্থার দিকে গেলে, মঙ্গলবার দুপুরে সুকুমার অনেক কষ্টে একটি নৌকা ভাড়া করেন। তিনি ও তার স্ত্রী মিলে প্রিয়বালাকে নিয়ে ছুটেন হাসপাতালের দিকে। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন প্রিয়বালা।
মায়ের মরদেহ নিয়ে আবার ঘরে ফিরে আসেন সুকুমার। কিন্তু চারদিকে পানি। শ্মশানে দাহ করার মতো অবস্থা নেই। এবার শুরু হয় প্রিয়বালাকে সমাধিস্থ করার নতুন যুদ্ধ। উঠানে, ঘরে পানি। কোথাও সমাধিস্থ করার উপায় নেই।
Advertisement
পেশায় দর্জি সুকুমার চন্দ্র বর্মণ বলছিলেন, মাকে যখন রান্নাঘরের মেঝেতে সমাধিস্থ করার জন্য মাটি খুঁড়ছিলেন তখন ওই কক্ষে পানি ছিল না। অন্য সব কক্ষে পায়ের পাতা অবধি পানি। একপর্যায়ে কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়তে থাকলে গর্তের মধ্যে পানি উঠা শুরু করে। একদিকে তিনি মাটি খুঁড়ছিলেন আরেকদিকে স্ত্রী পানি সেচে ফেলছিলেন।
মোটামুটি কিছুটা গর্ত করার পর প্রিয়বালাকে যখন শোয়ানো হচ্ছিল তখন সেখানে পানি ঢুকে যাচ্ছিল। তারপরও কোনো রকমে তাকে মাটিচাপা দেওয়া হয়।
সুকুমার আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘চারদিকে হানি (পানি), মা রে কই নিমু, কন্ডে (কোথায়) দাহ করমু, কন্ডে কবর দিমু! একবার চিন্তা করচ্চি কলার ভেলায় ঘরের পাশের নদীতে ভাসায় দিমু, আবার চিন্তা কইচ্চা (করেছি) একমাত্র মা, কেন্নে ভাসামু নদীতে? হরে (পরে) ঘরের ভিত্তে পাকের ঘরের মেঝের মাটি খুঁড়ি হানির ভিত্তে দাফন দিসি।’
শুক্রবার সুকুমার বলছিলেন, ঘরের পানি কমলেও উঠানে এখনো হাঁটুপানি। মায়ের শেষ পরিণতি এমন হবে কখনো ভাবিনি।
Advertisement
বন্যা শুরুর পর ২১ আগস্ট রাতে বাড়ি ছেড়ে দাগনভূঞার বিরলী বাজার আব্দুস সাত্তার মার্কেটের আশ্রয়কেন্দ্রে পরিবার নিয়ে উঠেছিলেন অটোরিকশার চালক ষাটোর্ধ আবুল কাশেম। পানিতে ডুবেছে ঘর, নষ্ট হয়েছে উপার্জনের একমাত্র অটোরিকশাটিও। এ নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। এরমধ্যেই বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আবুল কাসেম দাগনভূঞা উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের বক্তারপুর কাজী বাড়ির দেলুমিয়ার ছেলে।
স্থানীয় মো. শাহজালাল জানান, আবুল কাশেমের গ্রামের বাড়ি পানিতে ডুবে আছে। এ অবস্থায় পরিবারের সবার সিদ্ধান্তে রাতে সিন্দুরপুর বাজারের অলাতলী গ্রামের একটি উঁচু স্থানে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়। জানাজায় আবুল কাশেমের দুই ছেলেসহ আশপাশের লোকজন উপস্থিত ছিলেন।
আবদুল্লাহ আল-মামুন/জেডএইচ/জিকেএস