ভ্রমণ

উত্তরা গণভবনে যা কিছু আছে দেখার

নাটোর শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে ইতিহাস খ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি তথা উত্তরা গণভবন অবস্থিত। এর বয়স ৩০৩ বছর, তবুও মাথা উঁচু করে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাসাদটি। বিশালাকার এ জমিদার বাড়িতে আছে দিঘী, বাগান, ইটালিয়ান গার্ডেন, চিড়িয়াখানা আরও কত কী! গণভবনটি ৪১ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত। পুরো গণভবনের চারপাশে উঁচু করে দেওয়াল উঠানো।

Advertisement

প্রাসাদের পূর্বপাশে পিরামিড আকৃতির চারতলা প্রবেশদ্বার আছে। যা উপরের দিকে সরু হয়ে গেছে। এর ওপরে আছে একটি ঘড়ি। জানা যায়, ঘড়িটি রাজা দয়ারাম সেই সময় ইংল্যান্ড থেকে এনেছিলেন। ঘড়ির পাশে আছে একটি বিরাট ঘণ্টা। একসময় নাকি এই ঘণ্টার ধ্বনি বহুদূর থেকে শোনা যেত।

মূল ফটক ধরে প্রাসাদের ভেতর যেতেই আপনার চোখে পড়বে বহু প্রাচীন ও দুর্লভ প্রজাতির গাছের সমারোহ। সেখানে আছে রাজ-অশোক, সৌরভী, পরিজাত, হাপাবমালি, কর্পূর, হরীতকী, যষ্টিমধু, মাধবী, তারাঝরা, মাইকাস, নীলমণিলতা, হৈমন্তীসহ বিভিন্ন দুর্লভ প্রজাতির ফলজ ও ওষুধি বৃক্ষ।

প্রাসাদের প্রবেশ পথের চারিদিকে প্রাসাদঘেরা পরিখা, যা পুরো রাজপ্রাসাদকে ঘিরে রেখেছে। ভেতরে বিশাল মাঠ ও গোলাপ-বাগান, একপাশে গণপূর্ত অফিস। দ্বিতল হলুদ ভবনটি ‘কুমার প্যালেস’ নামে পরিচিত। আছে সে সময়কার চারটি কামান, যেগুলোর স্থাপনকাল ১৭৯৯ সাল।

Advertisement

বিশাল রাজদরবার সংলগ্ন বাগানে জমিদার দয়ারামের একটি ভাস্কর্য দেখবেন। প্রাসাদের মধ্যে একটি মিলনায়তন ভবনসহ আছে আরও দুটি ভবন। গাড়ি পার্ক করার আছে আলাদা গ্যারেজ। প্রাসাদের ভেতর আছে ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসপত্র। ভবনের মধ্যে জাদুঘর, বহু দর্শনীয় স্মৃতিস্তম্ভ, ভাস্কর্য ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য বিদ্যমান। এসব নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘উত্তরা গণভবন সংগ্রহশালা’।

নাটোরের গণভবনের ইতিহাস

নাটোরের রানি ভবানী তার নায়েব দয়ারামের উপরে সন্তুষ্ট হয়ে দিঘাপতিয়া পরগনা উপহার দেন। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত করে। এরপর ১৯৫২ সালে দিঘাপতিয়ার শেষরাজা প্রতিভানাথ রায় সপরিবারে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রাজপ্রাসাদটি পরিত্যক্ত থাকে।

১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার সরকারি ভবন হিসেবে এ প্রাসাদের সংস্কার করে। ১৯৭২ সালে এটিকে উত্তরা গণভবন হিসেবে অভিহিত করা হয়। চারদিকে মনোরম লেক, সুউচ্চ প্রাচীর পরিবেষ্টিত ছোট-বড় ১২টি কারুকার্যখচিত ও দৃষ্টিনন্দন ভবন নিয়ে আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচিয়ে রেখেছে উত্তরা গণভবন।

বাংলার রাজা-জমিদারদের মধ্যে দিঘাপতিয়া রাজবংশ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। দয়ারাম রায় এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ১৬৮০ সালে নাটোরের প্রখ্যাত কলম গ্রামের এক তিলি পরিবারে দয়ারাম রায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম নরসিংহ রায়।

Advertisement

নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রামজীবন যখন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ণের অধীনে চাকরি করতেন, সে সময়ে তিনি কাজ উপলক্ষ্যে চলনবিল এলাকার কলম গ্রামে পৌঁছান। রামজীবন যখন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ন ঠাকুরের অধীনে কর্মচারী ছিলেন, তখন দয়ারাম তার মাসিক ৮ আনা বেতনে চাকুরি করতেন।

আরও পড়ুন তুরস্ক ভ্রমণে যে ১০ স্পট ঘুরতে ভুলবেন না  কম খরচেই ঘুরে আসতে পারবেন বিশ্বের এই ৫ দেশে 

পরে সামান্য লেখাপড়া করে জমা খরচ রাখার মতো যোগ্যতা অর্জন করেন। রামজীবন তাকে মাসিক ৮ আনার পরিবর্তে ৫ টাকা বেতনে নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়নের স্নেহ, ভালবাসা ও সহানুভুতি পেতে থাকেন তিনি। বাংলার নবাব দেওয়ান মুর্শিদকুলী খানের প্রিয়ভাজন হওয়ায় দয়ারাম জমিদারী লাভ করেন। তখন তারও ভাগ্য খুলে যায়।

প্রথমে রাজা রামজীবনের একজন সাধারণ কর্মচারী থাকলেও প্রতিভা, দক্ষতা আর বিশ্বস্ততা দিয়ে নাটোর রাজের দেওয়ান পর্যন্ত হয়েছিলেন দয়ারাম। রাজা রামজীবন তাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন এবং প্রচুর অর্থ-সম্পদ তার কাছে গচ্ছিত রাখতেন। রাজা সীতারাম রায়ের পতনের পর দয়ারাম রায় নাটোর রাজ্যের একজন পরাক্রমশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।

যশোহরের রাজা সীতারাম রায় বিদ্রোহী হলে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ নাটোর রাজের দেওয়ান দয়ারাম এর সাহায্যে তাকে দমন ও পরাজিত করে নাটোর কারাগারে বন্দি করে রাখেন। সীতারাম রায়কে পরাজিত করায় নবাব সরকারের দয়ারামের প্রভাব বেড়ে যায় এবং তিনি ‘রাই রাইয়া’ খেতাবে ভূষিত হন। সীতারাম রায়কে পরাজিত করে তিনি মূল্যবান সম্পদসমূহ লুন্ঠন করেন।

তবে সীতারামের গৃহদেবতা কৃষ্ণজীর মূর্তি ছাড়া সব রামজীবনের হাতে অর্পন করেন। দয়ারামের এহেন ব্যবহারে রামজীবন খুশি হয়ে দয়ারামকে কৃষ্ণজীর মূর্তি স্থাপনের জন্য পুরস্কার স্বরূপ দিঘাপতিয়ায় একখণ্ড জমি দান করেন। সেইসঙ্গে বর্তমান বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দির চন্দনবাইশা এলাকার নওখিলা পরগনাও দান করেন।

এটিই দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রথম জমিদারী। পরে তিনি লাভ করেন পরগনা ভাতুরিয়া তরফ নন্দকুজা, যশোহরের মহল কালনা ও পাবনা জেলার তরফ সেলিমপুর। এভাবে দিঘাপতিয়া রাজবংশের ও জমিদারীর গোড়াপত্তন হয় ১৭৬০ সালে।

উত্তরা গণভবন পরিদর্শনের সময়সূচী

গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত উত্তরা গণভবন দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। শীতকালে ৫টায় তা বন্ধ করে দেয়া হয়। সপ্তাহের প্রতি রবিবার উত্তরা গণভবন বন্ধ থাকে। গণভবনের আঙিনায় প্রবেশ করতে ২০ টাকা মূল্যে টিকেট ক্রয় করতে হয়।

উত্তরা গণভবনে যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে নাটোর যাওয়ার বেশ কিছু বাস সার্ভিস রয়েছে। এদের মধ্যে- গ্রিন লাইন, হানিফ, দেশ, শ্যামলী এবং ন্যাশনাল পরিবহন উল্লেখযোগ্য। এসব পরিবহণের বাসগুলো নিয়মিতভাবে ঢাকার কল্যানপুর ও গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে নাটোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।

বাসভেদে জনপ্রতি টিকেটের মূল্য নন-এসি ৩৮০ টাকা এবং এসি ৬০০ টাকা। নাটোর বাস স্টপ কিংবা রেলস্টেশন থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় উত্তরা গণভবন যেতে মাত্র ১৫ মিনিট সময় লাগে।

কোথায় থাকবেন ও খাবেন?

নাটোরে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল ও বোডিং রয়েছে। হোটেল ভি.আই.পি এবং হোটেল রুখসানায় সিংগেল কেবিন ২৫০ থেকে ৩০০ ও ডাবল কেবিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা ভাড়ায় রাত্রিযাপন করতে পারবেন। এ ছাড়াও বেশকিছু বিভিন্ন মানের রেস্টুরেন্ট বা হোটেল আছে। সেখানে মাছ ও কাঁচাগোল্লার স্বাদ নিতে পারেন।

জেএমএস/জিকেএস