কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে এক তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে প্রথমে সাধারণ নাগরিকরা রাস্তায় নেমেছিলেন। তাদের নেতৃত্বে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। তাই কীভাবে বিক্ষোভকারীদের মোকাবিলা করা হবে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং মমতা ব্যানার্জীর সরকার চিন্তায় ছিল।
Advertisement
তবে সম্প্রতি রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ওই ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছে। এমন চেনা-জানা রাজনৈতিক বিরোধীদের মোকাবিলা সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের জন্য সুবিধাজনক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
নির্দলীয় প্রতিবাদআর জি কর হাসপাতালের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা সংগঠন প্রতিবাদে নামলেও সিংহভাগ প্রতিবাদ মিছিলের সংগঠক বা যোগদানকারীরা একেবারেই সাধারণ নাগরিক।
তবে প্রথমদিকের ওই প্রতিবাদ মিছিলগুলোতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা যে অংশ নেননি, তা নয়। ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতাই ঘোষণা দিয়ে মিছিলগুলোতে যোগ দিয়েছিলেন- বিশেষ করে ১৪ আগস্টের ‘রাতের রাস্তা দখল’ কর্মসূচিতে।
Advertisement
ছিলেন অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরাও। কিন্তু কারও গলায় সেদিন কোনো দলীয় স্লোগান শোনা যায়নি, দেখা যায়নি কোনো দলের পতাকাও।
আরও পড়ুন>>
রাজ্য সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বাংলাদেশকে অনুসরণ করা হচ্ছে: মমতা ‘নবান্ন’ ঘেরাও কর্মসূচির শুরুতেই পুলিশের জলকামান-টিয়ার শেল পশ্চিমবঙ্গে ১২ ঘণ্টার অবরোধের ডাক বিজেপিরএ ধরনের একাধিক মিছিল-জমায়েতে যোগ দিয়েছেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সির ছাত্র অঙ্কুশ পাত্র।
তিনি বলেন, অনেক স্কুল-কলেজের মিছিলেই দেখছি সাধারণভাবে একটা আবেদন থাকছে, দলবিহীন, দলীয় পতাকাবিহীনভাবে প্রতিবাদে শামিল হতে হবে। তাদের নিজেদের মধ্যে হয়তো ডিবেট হচ্ছে, মতানৈক্য হচ্ছে, তবে যখন তারা পথে নামছে, সেখানে কিন্তু কেউ কোনো দলের কথা বলছে না বা দলীয় প্রভাব থাকছে না। তাদের গলায় যে স্লোগান শোনা যাচ্ছে, তা হলো ‘বিচার চাই’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
Advertisement
অঙ্কুশের কথায়, আবার যখন প্রধান বিরোধী দলকে প্রতিবাদে নামতে দেখা যাচ্ছে, সেটি দেখে অনেক সাধারণ নাগরিক প্রতিবাদ থেকে শারীরিকভাবে পিছিয়ে যাচ্ছেন। তারা বলছেন, মানসিক সমর্থন থাকবে এই ইস্যুর প্রতি। কিন্তু যখন রাজনীতি ঢুকে পড়েছে, তখন আর সরাসরি সামনে আসবো না আমরা।
অচেনা প্রতিবাদকারীদের মোকাবিলা কীভাবে?পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের নাগরিক প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে দীর্ঘদিন পরে। এর আগে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে কিছুটা এ ধরনের নাগরিক প্রতিবাদ দেখা গিয়েছিল। তবে সেটি ছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের নীতির বিরুদ্ধে। আর এবারের প্রতিবাদ যেমন হচ্ছে বিচারের দাবিতে, তেমনই উঠে আসছে সমাজে পুঞ্জীভূত ক্ষোভও।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্রের মতে, সাধারণ মানুষের এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারের কাছে অভিনব।
তিনি বলেন, এর একটি কারণ হলো- এই প্রতিবাদীরা একেবারেই অচেনা-অজানা। কীভাবে এদের মোকাবিলা করা হবে, তা ক্ষমতাসীন দল বা সরকার জানে না।
আরও পড়ুন>>
কলকাতায় সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি, ছাত্র সমন্বয়ক সায়ন গ্রেফতার শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে যোগ দেওয়ায় স্কুলে স্কুলে মমতা সরকারের নোটিশ নিজের ছেলে-মেয়ে নেই, তাই সন্তান হারানোর কষ্ট বুঝতে পারছেন না মমতাশুভাশিস মৈত্র বলেন, সাধারণ নাগরিকদের প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল ধর্ষণ ও হত্যার শিকার এক নারীর বিচারের দাবিতে, বৃহত্তর প্রেক্ষিতে নারী সুরক্ষার দাবিতে। রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি শুরুর দিকে এই আন্দোলনে সেভাবে সরাসরি জড়িত ছিল না। তারা যখন দেখলো, পতাকা ছাড়াই প্রতিবাদে ব্যাপক সাড়া পড়েছে, তখন নেমে পড়লো নবান্ন ঘেরাও বা বনধ ইত্যাদিতে। সেটি আদৌ সাড়া ফেলেছে কি না, তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু, বিজেপির আন্দোলন মোকাবিলা করা তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে অনেক সুবিধাজনক। কারণ এটি দুপক্ষের কাছেই চেনা রাজনৈতিক ময়দান, চেনা প্রতিপক্ষ।
হারিয়ে যাবে সামাজিক দাবি?রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি আর জি করের ঘটনার প্রতিবাদে নেমে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তুলেছে। আর এই দাবি ওঠার পরেই তৃণমূল কংগ্রেস টেনে আনছে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে ঘটে যাওয়া নৃশংস ধর্ষণ-হত্যার নানা ঘটনার কথা।
বিরোধী দল যখন আর জি কর কাণ্ডে বিচার এবং মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাইছে, তখন ক্ষমতাসীন দলও দোষীদের ফাঁসি চাইছে।
এই রাজনৈতিক দাবি-পাল্টা দাবির মধ্যে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হওয়া তরুণী চিকিৎসকের বিচারের দাবি কিছুটা লঘু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।
আরও পড়ুন>>
মমতার ওপর গোয়েন্দা নজরদারির দাবি বিজেপির মমতা ব্যানার্জীর বিরুদ্ধে এফআইআর যে ঘটনায় উত্তাল ভারত, কী হয়েছিল চিকিৎসক তরুণীর সঙ্গে?গত ২০ দিন ধরে নানা প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হয়েছেন কলকাতার পেশাজীবী সুজাতা ঘোষ। তিনি বলেন, আমাদের একটাই চাওয়া– বিচার। ওই তরুণী চিকিৎসক যেন বিচার পান। তবে এখন যা দেখছি, ব্যাপারটার মধ্যে বিজেপি চলে আসায় বিজেপিশাসিত রাজ্যগুরোতে ঘটে যাওয়া একই ধরনের নৃশংস ধর্ষণ-হত্যার প্রসঙ্গ টেনে আনছে তৃণমূল কংগ্রেস।
‘হাথরাস-উন্নাও বা কাঠুয়ার ঘটনাগুলো কোনো অংশেই কম নৃশংস ছিল না। কিন্তু বিষয়টাতে রাজনৈতিক দলগুলো চলে আসার ফলে আমাদের মেয়েটির বিচারের দাবি লঘু হয়ে যাবে না তো? এই প্রশ্নটা আমার বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে শুরু করেছে’।
তার কথায়, গত ১৪ অগাস্ট রাতে যেভাবে সব রাস্তায় শুধু কালো মাথা দেখা গিয়েছিল, সেরকমই যদি করে দেওয়া যেতো, তাহলে মনে হয় রাজনৈতিক দলগুলো এই নৃশংস ঘটনা নিয়ে তাদের পরিচিত তরজা করতে পারতো না। তারা এটা টের পেত যে, সাধারণ মানুষ আসলে শুধুই বিচার চায়। মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ তো দাবি নয়!
এ প্রসঙ্গে বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র বলেন, এই প্রতিবাদ আন্দোলনে নারীরা যে বিচারের দাবি তুলেছিলেন, তার সঙ্গেই নারীদের নিরাপত্তার দাবিও উঠেছিল। এই নিরাপত্তার সামাজিক দাবিটা আবার বহুমাত্রিক ছিল। এখন রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনে ঢুকে পড়ার ফলে ওই সামাজিক দাবিগুলো হারিয়ে যাবে কি না, তা সময়ই বলবে।
সূত্র: বিবিসি বাংলাকেএএ/