চলমান বন্যায় মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমরা লক্ষ্য করেছি। সকল ধর্ম বর্ণের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বন্যার্তদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন। যারা যেভাবে বন্যার্তদের সেবা প্রদান করেছেন এবং করছেন তাদেরকে আল্লাহতায়ালা উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন।
Advertisement
আমার প্রতিবেশী সে যে ধর্মের বা মতের অনুসারীই হোন না কেন মানুষ হিসেবে তার একটি মর্যাদা রয়েছে। কিন্তু আজ আমরা লক্ষ্য করছি শুধু ধর্ম মতের ভিন্নতার কারণে প্রতিবেশীর উপর আক্রমণ করতেও একটি শ্রেণি দ্বিধা করছে না। অথচ বিপদে আপদে প্রতিবেশীই প্রথমে সাহায্যের হাত প্রসারিত করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা ক’জন এমন আছি যারা আমাদের প্রতিবেশীর বিপদে এগিয়ে যাই। এই সংখ্যা হয়ত খুবই কমই পাওয়া যাবে। অথচ আমাদের প্রিয়নবি (সা.) সকল ধর্ম মতের মানুষের সাথে উত্তম আচরণের কতই না চমৎকার শিক্ষা আমাদের দিয়ে গেছেন তা আজ আমরা বেমালুম ভুলে বসেছি।
হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) নিজ স্বার্থে কোনো প্রতিশোধ নিতেন না বরং শত্রুদের সাথেও তিনি সব সময় ভাল আচরণ করেছেন। যাকে খোদাতায়ালা সমগ্র পৃথিবীর জন্য রাহমাতুল্লিল আলামিন করে পাঠিয়েছেন, তিনি কীভাবে অন্যের প্রতি অবিচার করতে পারেন। তিনি (সা.) বিধর্মীদের সাথেও উত্তম আচরণ করেছেন।
হজরত আবু বকর (রা.) এর কন্যা আসমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবি করিম (সা.) এর যুগে আমার অমুসলিম মা আমার কাছে এলেন। আমি মহানবিকে (সা.) জিজ্ঞেস করলামÑআমি কি তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করব? তিনি (সা.) বললেন, হ্যাঁ’ (সহি বুখারি, কিতাবুল আদব)।
Advertisement
আমরা যদি মহানবির (সা.) জীবনাদর্শ পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, তিনি কতইনা উত্তম আচরণ করেছেন অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে আর একই শিক্ষা আমাদেরকে দিয়ে গেছেন। তিনি (সা.) যে দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, এরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাই এরূপ আজিমুশ্বান নবির (সা.) ওপর লক্ষ লক্ষ দরুদ ও সালাম।
হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একদা এক বেদুইন মসজিদে প্রস্রাব করলো। লোকেরা উঠে (তাকে মারার জন্য) তার দিকে গেল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তার পেশাব বন্ধ করো না। তারপর তিনি (সা.) এক বালাতি পানি আনলেন এবং পানি প্রস্রাবের ওপর ঢেলে দেয়া হল’ (সহি বুখারি, কিতাবুল আদব)।
মানব সেবায় আত্মনিয়োগকারী ব্যক্তির প্রতি মহানবি (সা.) শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন ও তাদের খেয়াল রাখতেন একবার তাঈ গোত্রের লোকেরা মহানবির (সা.) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এতে তাদের কিছু সংখ্যক লোক বন্দী হয়ে এসেছিল। তাদের মধ্যে আরবের প্রসিদ্ধ দাতা হাতেম-এর এক মেয়েও ছিল। যখন সে মহানবির (সা.) কাছে বললো, সে হাতেম তাঈ এর মেয়ে, তখন তার সঙ্গে হজরত মুহাম্মদ (সা.) অত্যন্ত আদব ও সম্মানের সঙ্গে ব্যবহার করলেন এবং তার সুপারিশক্রমে তার গোত্রের শাস্তি ক্ষমা করে দিলেন। (সিরাত হালবিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ-২২৭)।মহানবির (সা.) ক্ষমার এই অনুপম শিক্ষা যদি আজ আমরা আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে সমাজ থেকে অশান্তি আর বিশৃঙ্খলা দূর হবে এটা নিশ্চিত।
হজরত রাসুল (সা.)-এর ক্ষমার দৃষ্টান্ত দেখুন, মক্কার লোকেরা যখন মহানবির (সা.) আর কোন কথাই শুনতে চাচ্ছিল না, তখন তিনি (সা.) তায়েফে আল্লাহর বাণী পৌঁছানোর দিকে দৃষ্টি দিলেন। তিনি (সা.) যখন তায়েফ পৌঁছলেন, তখন সেখানকার নেতৃবৃন্দ তার সাথে দেখা করার জন্য আসতে লাগলো। কিন্তু কেউই সত্য গ্রহণ করতে রাজী হলো না। সাধারণ লোকেরাও তাদের নেতাদেরই অনুসরণ করল এবং খোদার বাণীর প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করতে লাগলো।
Advertisement
পরিশেষে তারা সব ভবঘুরে ছেলে ছোকরাদেরকে একত্রিত করলো। তারা প্রত্যেকেই ঝোলা ভর্তি পাথরের টুকরা নিল। তারা নির্মমভাবে মানব দরদি রাসুলের (সা.) ওপর পাথর ছুঁড়তে থাকে। অবিশ্রান্তভাবে পাথর মারতে মারতে মহানবিকে (সা.) শহর থেকে বাইরে নিয়ে গেল। মহানবির (সা.) দু’টি পা রক্তাক্ত হয়ে উঠলো। তারপরও তারা বিরত হলো না, যতক্ষণ না তিনি (সা.) শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি পাহাড়ে এসে পৌঁছলেন। এই লোকগুলো যখন তাঁর পিছু পিছু ধাওয়া করছিল, তখন তিনি এই ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন যে, আল্লাহর গজব না আবার তাদের ওপর পড়ে। তিনি আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখছিলেন এবং কাতর প্রাণে প্রার্থনা করছিলেন, ‘হে খোদা! তুমি এদেরকে ক্ষমা করে দাও! কেননা এরা জানে না, এরা কি করছে।’
আঘাতে জর্জরিত ও লোকদের তাড়া খেয়ে তার শরীরে চলার মত আর শক্তি ছিল না। এত কিছুর পরও তিনি (সা.) তাদের অভিশাপ দেননি বরং তাদের জন্য দোয়াই করেছেন। এমনই ছিল শ্রেষ্ঠ রাসুল মহানবির (সা.) আদর্শ। আমরা যদি মহানবির (সা.) জীবনাদর্শ পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, তিনি কতইনা উত্তম আচরণ করেছেন অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে আর একই শিক্ষা আমাদেরকে দিয়ে গেছেন। তিনি (সা.) যে দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, এরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাই এরূপ আজিমুশ্বান নবির (সা.) ওপর লক্ষ লক্ষ দরুদ ও সালাম।
আল্লাহপাক আমাদেরকে শ্রেষ্ঠনবির ক্ষমার এই অনুপম আদর্শ নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামী চিন্তাবিদ।masumon83@yahoo.com
এইচআর/জিকেএস