কুষ্টিয়ার কুমারখালী পৌরসভায় ১৫৩ বছরেও হয়নি আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা। অপরিকল্পিত যতটুকু নালা ছিল, তাও সংস্কার হয় না এক যুগ ধরে। ফলে দখল, দূষণ ও নানা স্থাপনার কারণে সেটুকুও অস্তিত্ব সংকটে। এতে কয়েকদিনের বৃষ্টিতে হাসপাতাল, উপজেলা পরিষদ চত্বর, স্কুল, কলেজ, সড়ক, বাড়িঘরসহ পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এ কারণে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক কার্যক্রম। সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগী, স্বজন, চিকিৎসকসহ নানান শ্রেণিপেশার মানুষ।
Advertisement
ড্রেনেজ খাল সংস্কার না করে পানি নিষ্কাশনের জন্য কয়েকটি স্থানে ইঞ্জিনচালিত শ্যালো মেশিন বসিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ। শ্যালো মেশিন দিয়ে জমে থাকা পানি সেচে গড়াই নদীতে ফেলা হচ্ছে। পৌরসভার এমন উদ্যোগকে ‘হাস্যকর’ বলছেন স্থানীয়রা। তারা দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য পরিকল্পিত ও আধুনিক খাল বা নালা তৈরির দাবি জানিয়েছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, উপজেলা পরিষদ চত্বর, উপজেলা পরিষদ মাঠ, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; ১, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কয়েকশ বাড়িঘর প্লাবিত। পানি মাড়িয়ে চলাচল করছেন রোগী, স্বজনসহ নানান শ্রেণিপেশার মানুষ। পৌরসভার পায়রা মোড় এলাকায় শ্যালো ইঞ্জিনচালিত মেশিন দিয়ে পানি সেচে খালে ফেলা হচ্ছে।
এসময় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসা সাথী খাতুন বলেন, ‘হাসপাতালের চারদিকে হাঁটুসমান পানি। পুরুষেরা কাপড় উঁচু করে চলাচল করছে। কিন্তু আমরাতো পারছি না। পানির কারণে মানুষের খুব কষ্ট হচ্ছে।’
Advertisement
ভ্যানচালক ওয়াসিম বলেন, ‘পানি বের হওয়ার রাস্তা নেই। একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। এতে আমাদের অনেক কষ্ট হয়।’ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মু. আহসানুল সিজান রুমী জানান, পৌরসভার পরিকল্পিত ড্রেনেজ খাল না থাকায় হাসপাতালের জরুরি ও বহির্বিভাগের সামনে এবং কোয়ার্টার ভবনের চারদিকে পানি থই থই করছে। আমরা পড়েছি বিপাকে।
পৌর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গড়াই নদীর কূলঘেঁষে ১৮৬৯ সালে নির্মিত কুমারখালী পৌরসভায় ৯টি ওয়ার্ডে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের বসবাস। প্রায় এক যুগ আগে পৌরসভার পূর্বাঞ্চলীয় পানি অপরিকল্পিত ইটের তৈরি সরু ড্রেনেজ দিয়ে পানি মাছ বাজার, ফুলতলা রেলসেতু, কলেজমোড়, বাটিকামারা সেতু হয়ে গড়েরমাঠ সেতু দিয়ে বিভিন্ন বিল ও পদ্মা নদীতে চলে যেতো। আর পশ্চিমাঞ্চলীয় পানি কাজিপাড়া, মাতৃসদন হাসপাতাল হয়ে কুণ্ডুপাড়া এলাকা দিয়ে গড়াই নদীতে পতিত হতো। কিন্তু দীর্ঘদিন ড্রেনেজ খাল সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ না হওয়ায় তা দখলে, দূষণে ও নানান স্থাপনায় হারিয়ে গেছে। এতে প্রতি বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, জলাবদ্ধতা নিরসনে গড়ে প্রতি ওয়ার্ডে তিন কিলোমিটার করে মোট ২৭ কিলোমিটার ড্রেনেজ খাল বা নালার প্রয়োজন। তার মধ্যে পূর্বের অপরিকল্পিত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার খাল আছে। তবে সরকারিভাবে বড় কোনো বরাদ্দ না পাওয়ায় এতদিনেও নালা বা খাল তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তবে ২০২৩ সালে আইইউজিআইপি নামের ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়েছে। তার মধ্যে চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রায় ৪০ কোটি টাকার কার্যাদেশ পাওয়া গেছে। তা দিয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার আধুনিক নালা নির্মাণের কাজ চলছে।
৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মতিয়ার রহমান বলেন, ‘১০-১২ বছর আগে এই অঞ্চলের পানি ফুলকলা রেলসেতু, কলেজমোড়, বাটিকামারা সেতু হয়ে গড়েরমাঠ বিল দিয়ে পদ্মায় চলে যেতো। এখন খাল বন্ধ করে মানুষ বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। সেজন্য পানি আর বের হতে পারে না।’
Advertisement
একই এলাকার শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে খাল সংস্কার না হওয়ায় মানুষের ঘরবাড়ি, পথে-ঘাটে পানি জমে থাকে। ভোগান্তি কমাতে দ্রুত খাল খননের দাবি জানান।
কুমারখালী দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার বাসিন্দা হাবীব চৌহান বলেন, ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি জমে আছে। অথচ ড্রেন নির্মাণ না করে পৌর কর্তৃপক্ষ মেশিন দিয়ে পানি সেচে ফেলছে। এটা ‘হাস্যকর’।
পানি নিষ্কাশনের জন্য তিনটি মেশিন সেট করে সেচে তা গড়াই নদীতে ফেলা হচ্ছে বলে জানান কুমারখালী পৌরসভার সার্ভেয়ার ফিরোজুল ইসলাম।
কুমারখালী পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী মো. আকরামুজ্জামান জানান, দখল, দূষণে ও নানান স্থাপনায় আগের খালটি মৃতপ্রায়। আবার ১৫৩ বছরেও বড় কোনো বরাদ্দ না পাওয়ায় পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
তিনি আরও জানান, জলাবদ্ধতা নিরসনে পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে প্রায় ২৭ কিলোমিটার খালের প্রয়োজন। সম্প্রতি একটি বড় প্রকল্প পাস হয়েছে। সেখানকার অর্থায়নে প্রায় দেড় কিলোমিটার খাল খননের কাজ চলছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে জলাবদ্ধতা আর থাকবে না।
নালার অভাবে জলাবদ্ধতায় মানুষ চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম। তিনি বলেন, পৌর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।
আল-মামুন সাগর/এসআর/এমএস