জাতীয়

চমেকে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে গুলিবিদ্ধ দুই শিক্ষার্থী

৪ আগস্ট। গণঅভ্যুত্থানের একদিন আগে চট্টগ্রাম হয়ে উঠেছিল অগ্নিগর্ভ। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনগুলোর সশস্ত্র হামলায় আহত হন দুই শতাধিক ছাত্র-জনতা। সেদিন মাথায় গুলিবিদ্ধ হন দুই শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম আরিফ ও মো. হাসান। বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তারা।

Advertisement

মো. হাসান (১৮) চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরস্থ গরীবে নেওয়াজ উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এর আগে তিনি কোরআন হেফজ করেন। ৪ আগস্ট দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের টাইগারপাশ এলাকায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হন হাসান।

ওইদিন একই সময়ে নগরের সিআরবি এলাকায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হন ফেনীর তরুণ সাইফুল ইসলাম আরিফ (১৯)। তিনি স্থানীয় একটি মাদরাসা থেকে দাখিল পাস করে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। চট্টগ্রামে চাচার বাসায় বেড়াতে এসে যোগ দেন আন্দোলনে।

চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে গুলিবিদ্ধ মো. হাসান

Advertisement

বুধবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, এই দুই তরুণের কারোই জ্ঞান নেই। দীর্ঘ পঁচিশ দিনের বেশি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে শরীর হয়ে গেছে শীর্ণকায়। হাসানের বেডের পাশে দাঁড়ানো ছিলো তার মা ও বোন। আইসিউর বাইরে অপেক্ষায় আছেন আরিফের বাবা আলতাফ হোসেন।

তারা জানালেন, দুজনের কাউকেই মুখে খাবার দেওয়া হচ্ছে না। নিয়ম করে চলছে ক্ষত স্থানের ড্রেসিং এবং ওষুধ। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাদের অবস্থা খুব খারাপ।

এ সময় আইসিউতে কর্মরত এক চিকিৎসক জানান, হাসানের মাথার ডানপাশ দিয়ে গুলি ঢুকে অপরপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এতে স্কাল ও ব্রেইন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া মাথায় ভারি বস্তুর আঘাত আছে। আরিফও গুলিবিদ্ধ হয়েছে মাথার ডান পাশে। অপারেশন করে গুলি বের করা হলেও ব্রেনের ক্ষতি হয়েছে স্থায়ীভাবে।

চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে গুলিবিদ্ধ সাইফুল ইসলাম আরিফ

Advertisement

আরও পড়ুন

দিনভর সংঘর্ষে প্রাণ গেলো ৬ জনের আন্দোলনে নিহত হাজারের বেশি, চোখ হারিয়েছেন চার শতাধিক চট্টগ্রামে সংঘর্ষে আরও একজনের মৃত্যু

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘গুলিতে দুইজনই মাথায় মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। গত ২৬ দিনেও তাদের অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। এর মধ্যে হাসানের অবস্থা বেশি আশঙ্কাজনক। আমরা সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছি। এখন জীবন মৃত্যুর মালিক আল্লাহ তায়ালা।’

পরিবারের একমাত্র ছেলে ওরা:

হাসানের বাবা মারা গেছেন সেই ছোট বেলায়। দুই মেয়ে আর একছেলেকে নিয়ে কষ্টের সংসার পোশাক শ্রমিক মাহিনুরের। তারপরও তিন সন্তানকেই পড়ালেখা করিয়েছেন মাহিনুর।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে হাসান সবার বড়। শৈশবেই বাবাকে হারিয়েছে। কোরআান হেফজ শেষে স্কুলে ভর্তি করেছিলাম। আশা ছিল পড়ালেখা করে পরিবারের দুঃখ ঘোচাবে। আমার সেই ছেলে এখন মৃত্যু শয্যায়। সব আশা মাটি হয়ে গেছে।’

আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের নিউ মার্কেট এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর একে-৪৭ দিয়ে গুলি চালান সোলাইমান বাদশা নামের এই অস্ত্রধারী আওয়ামী লীগের কর্মী

আইসিউতে হাসানের বেডের পাশে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে বোন সুমাইয়া ইসলাম। অশ্রু সজল দু’চোখে চরম অনিশ্চয়তা।

সুমাইয়া বলেন, ‘ভাইয়া খুব মেধাবী। তাই তাকে মাদরাসায় না দিয়ে মা স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। ৪ তারিখ সকালে ভাইয়া আমাদের না জানিয়েই আন্দোলনে যোগ দেন। বিকেলে তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাই। চিকিৎসক বলেছেন, তার মাথায় গুলির পাশাপাশি ভারি বস্তু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। মানুষগুলো কি করে এত অমানুষ হলো?’

হাসানের মতোই দুই বোনের একমাত্র ভাই সাইফুল ইসলাম আরিফ। এসএসসি পাস করলেও গতবার কলেজে ভর্তি হননি। বাবাকে কৃষি কাজে সাহায্য করছিলেন। আন্দোলন চলাকালে ফেনী থেকে চট্টগ্রামে চাচার বাসায় বেড়াতে আসেন তিনি। সেখান থেকেই ৪ আগস্ট মিছিলে যোগ দেন আরিফ।

৪ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের এসএস খালেদ রোডে জামালখান ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের নেতৃত্বে শটগান ও পিস্তল হাতে দুই অস্ত্রধারীকে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় অংশ নিতে দেখা যায়

আরও পড়ুন

চট্টগ্রামে সংঘর্ষ শুরু যেভাবে চট্টগ্রামে ১৫ মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন, শিক্ষার্থীদের অব্যাহতি পা হারানো ছেলেকে নিয়ে অথই সাগরে শাহীন আলম

আরিফের বাবা আলতাফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘একমাত্র সন্তান আমার। আমি গরিব কৃষক, তাই ছেলেকে শিক্ষিত করতে চেয়েছিলাম। গতবার কলেজে ভর্তি হতে না পেরে অনেক দুঃখ করেছিল। তাই এবার চাচার বাসায় এসেছিল কলেজে ভর্তির খোঁজ নিতে। এখন সে মৃত্যু পথযাত্রী। আমার বংশের প্রদীপ জ্বালানোর আর কেউ রইলো না।’

কী ঘটেছিলো ৪ আগস্ট:

৩ আগস্ট রাত থেকেই আঁচ করা যাচ্ছিলো ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে। ওই রাতে নগরের বহদ্দারহাটে গুলিতে নিহত হন এক ব্যবসায়ী। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দেখে নেওয়ার প্রকাশ্যে হুমকি দিতে থাকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। রোববার দুপুর গড়ানোর আগেই সেই শঙ্কা বাস্তবে রূপ নেয়।

৪ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের কদমতলি ও নিউ মার্কেট এলাকায় শটগান ও পিস্তল হাতে ছাত্রলীগের মিছিল থেকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়

পূর্বে ঘোষণা অনুযায়ী ৪ আগস্ট সকাল ১০টার আগেই নগরের নিউ মার্কেট এলাকায় অবস্থান নেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নগরের সিটি কলেজ এলাকা থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এ সময় আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এরপর আন্দোলনকারীরা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে কদমতলী, কোতয়ালী ও রেয়াজউদ্দিন বাজারের আশপাশে অবস্থান নিলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে।

অন্যদিকে পুলিশের হামলা থেকে বাঁচতে তিনটি সড়কে অবস্থান নেওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা। এ সময়ই অধিকাংশ আন্দোলনকারী আহত হন।

৪ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের কদমতলি ও নিউ মার্কেট এলাকায় শটগান ও পিস্তল হাতে ছাত্রলীগের মিছিল থেকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়

এ সময় ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অত্যাধুনিক একে-৪৭, শটগান, পিস্তল, লংরেঞ্জ রাইফেল, চাইনিজ কুড়াল, রাম-দাসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের ওপর প্রকাশ্যে গুলি চালানো হয় নগরের কদমতলি, টাইগারপাস, সিআরবি, দেওয়ানহাট, এনায়েত বাজার, কাজীর দেউরী ও বহদ্দারহাটে। আন্দোলনকারীদের অনেককে ছুরিকাঘাত করা হয় প্রকাশ্যে।

সেদিন রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন শিশুসহ ২০৩ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১৭২ জনের মধ্যে ১১০ জনই ছিলেন গুলিবিদ্ধ। তিনজনকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালের আইসিইউতে।

এএজেড/এমআরএম/এমএস